বাংলাদেশের আইন: আইন আছে, আইন নাই

একসময় আমার সরকারে দরকার ছিল না। অন্তত তাই মনে করতাম। দেশি- বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময় বোঝা দরকার হয়নি। দরকার শুরু হল তখন, যখন থেকে নিজের উদ্যোগ শুরু করলাম। বুঝলাম সরকারে দরকার সবসময় হয়। চাকরি করার সময় আমাদের প্রতিষ্ঠানে এধরনের কাজে আলাদা লোক ছিল। তারা আইনি ঝামেলা (!) মেটাতো।

যখন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলাম, অ্যালার্জির শুরু তখন থেকেই। আইনের আঁচ বুঝতে শুরু করলাম। বুঝতে বাধ্য হতে থাকলাম – বাংলাদেশের আইন মানে, ‘কত ধানে কত চাল’। এই আইনগুলো কতখানি অবাস্তব। মনিয়ে চলা কতটা কঠিন। সেখান থেকেই এর মূল কারণ খুঁজে চলেছি।

আমি আইন বিশেষজ্ঞ না। আইনজ্ঞও না। আইন স্কুলে এক সময় ভর্তি হয়েছিলাম। তবে লেখাপড়া শেষ করতে পারি নাই। আমার দেখা আইন মানে — একজন ভুক্তভূগির দেখা আইন। এই লেখাটিও সেই ভুক্তভূগির জুতোয় পা দিয়ে লেখা।

বাংলাদেশে আছে অনেক আইন, নীতিমালা, প্রবিধানমালা, প্রজ্ঞাপন ইত্যাদি। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ হয়ে অসংখ্য আইন হয়েছে। গণতান্ত্রিক এবং সামরিক শাসকরা প্রত্যেকের আমলে নতুন কিছু আইন তৈরি করেছেন। সাময়িক সামরিক শাসকরাও দু একখানা তৈরি করার স্বাদ নিয়েছেন। প্রজ্ঞাপন, এসআও আরও কিসব নামে কিছু আইন আছে। সময়ের সাথে সাথে এগুলোর কিছু সামান্য হালনাগাদ হয়েছে। কিছু প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। পাশাপাশি একই বিষয়ে একাধিক আইন হয়েছে। আবার কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়ে কোন আইন তৈরি হয়নি।

অনেকগুলো আইন বিভিন্ন দেশের সেরা আইনের কপি। কিন্তু প্রয়োগের বাস্তবতা আর প্রয়োগ-ক্ষমতার অভাবে তার বেশিরভাগই অকার্যকর। এছাড়া একই বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বা সাংঘর্ষিক আইন রয়েছে। অসংখ্য কালো আইন রয়েছে। দরকারি আইনগুলোর সাথে কালো ধারা রয়েছে। একটি আইনে শাস্তির ধারা থাকলেও তা অন্য আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাবার সুযোগ রয়েছে। যে কারণে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এগুলো তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। তবে লোকের আইনের উপর শ্রদ্ধা নষ্ট করতে পুরোপুরি সফল হচ্ছে। হয়রানি করার কাজটা ভালভাবে করা যাচ্ছে। ফলাফল – ভূলবশত শাস্তি পেয়ে ভাল মানুষ অপরাধী হয়ে উঠছে। আর অপরাধীরা এই আইন ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে অপরাধ করে চলছে।

সময়ের সাথে অর্থনীতি, রাজনীতি, কর্মকৌশল সব কিছু বদলে যায়। আজকের জন্য বাস্তব আইন কাল সম্পূর্ণ অবাস্তব হতে পারে। আমরা আমাদের জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাই সেই আইন যুগোপযোগী রাখার জন্য। যেখানে আইন নেই, তারা সেগুলো প্রণয়ন করবেন। যেটা অবাস্তব, সেই আইন বাদ দেবেন। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা উল্টো। আমাদের আইন তৈরি করেন আমলারা, যাদের সাথে জনগণের কোন সম্পর্ক নেই। সেটা প্রভাবিত করে বিভিন্ন স্বার্থন্বেসী গ্রুপ। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শুধুমাত্র সেগুলোকে সংসদে তুলে হালাল করে দেন। যে কারণেই দিনে দিনে অসংখ্য প্রয়োগ অনুপযোগী জনবিরোধী আইন তৈরি হয়ে গেছে। পুরনোগুলো ঐতিহ্যের সাথে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যেগুলো সরকারে থাকা অবস্থায় সুবিধামতো প্রয়োগ করা যায়, হয়রানির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

সহজ কথা — যে আইন প্রয়োগ করা যায় না, তা থাকার দরকার নেই। সেটা থাকার বিভিন্ন রকম ক্ষতি আছে। আইন ভাঙা এক ধরণের বদোভ্যাস। অভ্যাসটা দ্রুত সংক্রামক। অনুপযোগী আইনগুলো প্রয়োগে কর্তৃপক্ষের নৈতিক জোর থাকে না। তাই সেটা কেউ ভাঙলে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এভাবে লোকের আইন ভাঙ্গার সাহস হয়। সেই সাহস একসময় অভ্যাস হয়ে যায়। এরপর তারা উপযুক্ত আইন ভাঙতে শুরু করে। আইন ভাঙা একসময় স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে যায়। তারপর তার প্রতিযোগিতা হয়। এভাবে একসময় পুরো সিস্টেম ভেঙ্গে পড়ে। যেটার কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গেছি।

এরপরও যেন আমরা মূল ইস্যুটা বুঝতে চাই না। অথবা না জানার কারণে আমাদের বিভ্রান্ত করা সহজ। আমরা কথায় কথায় নতুন আইন করার প্রস্তাব মেনে নেই। তৎক্ষণাৎ সুবিধাবাদীরা নিজের স্বার্থে তাতে উৎসাহ দেয়। এরপর অনর্থক আইনের বোঝায় নতুন আঁটি শাকের মতো নতুন আইন যোগ হয়। বোঝার ভারে শাসন-বিচারব্যবস্থা আরও খানিকটা নুইয়ে পড়ে।

বুঝতে হবে — অসংখ্য উন্নত আইন থাকা কার্যকর কিছু না। বিশ্বের সেরা আইন সব সময় সব দেশে উপযুক্ত আইন নাও হতে পারে। কম হোক, দরকার আমাদের উপযুক্ত এবং প্রয়োগযোগ্য আইন। সেই আইন বাস্তবায়নের অবকাঠামোগত ও কারিগরি ক্ষমতা আমাদের থাকতে হবে। নিয়মিত যুগোপযোগী করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এ ধারণাটি আমার আবিষ্কার না। কথাটাও নতুন নয়। এই ইস্যুটা মৌলিক। তাই যুগের হাওয়ায় খুব জনপ্রিয়ও না। তবে এটি ‘সকল নষ্টের মূল’ ইশ্যু। একটু চোখ খুলে তাকালেই বুঝতে পারবেন। দু একবার আইনের জাঁতাকলে থেঁতো হওয়ার অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে, তারা তো জানেনই।

তরুণ প্রজন্মের অনেকেই রাজনীতি নিয়ে ভাবছে। তাদের কাছে এই ভাবনা পরিষ্কার থাকা দরকার। বুঝতে হবে — এটাই রাজনীতিকদের প্রথম কাজ। সেটা করতে তাদের বাধ্য করতে হবে। নিজে নির্বাচিত হবার সুযোগ হলে এদিকে আগে হাত দিতে হবে। এই বস্তাভরা আইনের বোঝা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে। কালো আইনগুলোকে বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনীয় আইনগুলোকে যুগোপযোগী ও প্রয়োগযোগ্য করতে হবে। একটি কার্যকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এর বিকল্প নেই।

 

 

এডিট- এসএস

Leave a Comment