শীত ঋতুসংগীত নিয়ে আজকের আলোচনা। শীত আমাদের পঞ্চম ঋতু। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। প্রতিটি ঋতুর মতোই শীতকাল তার নিজস্ব রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়। হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে আসে শীত। শীতের কথা স্মরণ করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ। হিমেল বাতাসে কাঁপতে থাকে শীতার্ত মানুষজন। সারি সারি খেজুরগাছে ঝুলতে থাকা রসের ভাঁড়। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত রসের ভাঁড়ে মৌমাছিদের নৃত্য। ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর নয়নাভিরাম দৃশ্য। এটা শীত ঋতুর একটা সাধারণ চিত্র।
শীত আমাদের সবার প্রিয় ঋতু। এ ঋতু ফুল-ফসলে সমৃদ্ধ। তাই শীতকাল অন্য সব ঋতু থেকে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বাংলার রূপবৈচিত্র্যের অনেকখানি জায়গাজুড়ে শীতের অবস্থান। শীতের সকালের রূপ অন্য সব ঋতু থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। হেমন্তের দিনগুলো শেষ হতে না হতেই শীতবুড়ি এসে প্রকৃতিতে হাজির। কুয়াশা কন্যারাও নির্জন বন-মাঠ আর নদীর কূলজুড়ে ছাউনি ফেলে। উত্তর দিগন্তে হিমালয়ের বরফচূড়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস। পৃথিবী কেমন যেন জড়সড় হয়ে যায় শীতে। সূর্যের আলোয় সবুজ মাঠগুলোকে মনে হয় কে যেন মুক্তার দানা ছড়িয়ে রেখেছে। সেই দানাগুলো থেকে রামধনুর সাত রঙের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখলে পরাণ জুড়িয়ে যায়।
শর্ষের খেতগুলোকে মনে হয় হলুদের সাগর যেথায় হিমলে হাওয়া ঢেউ খেলে যায় প্রতিনিয়ত। মাঠে মাঠে হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি। বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর ঢাকা থাকে হলুদে চাদরে। প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখ জুড়াতে জুড়ি নেই সরিষা ফুলের। এই ফুল যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দেয় ভিন্ন মাত্রা, ঠিক কৃষকের মনে জাগায় স্বপ্ন। এ ছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, লাউ, মুলা, কুমড়া, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, শসা, মিষ্টিকুমড়ার খেতগুলো দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। এসব হাটবাজার থেকে লোকজনরা ব্যাগভর্তি করে শীতের সবজি নিয়ে বাসায় ফেরেন। এত সব পুষ্টিকর শাকসবজির পসরা অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না।
শীত মৌসুমে ফুলকাননের যেসব ফুল মানুষের মনকে মুগ্ধ করে তার মধ্যে ডালিয়া অন্যতম। লাল, চকোলেট, হলুদ, সাদা, গোলাপি, বেগুনি প্রভৃতি বর্ণের ডালিয়ার পাপড়ির সৌন্দর্য আর চমৎকার বিন্যাস সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। কৃষ্ণকলি শীত মৌসুমের নিজস্ব ফুল। এ ফুল সাদা আর গোলাপি রঙের হয়ে থাকে। শীত মৌসুমের আরেক ফুল কসমস। এ ফুল সাদা, লাল বা গোলাপি বর্ণের হয়।
এছাড়া শীত মৌসুমের আরো যেসব জনপ্রিয় ফুল রয়েছে তার মধ্যে গ্যাজানিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, অ্যাস্টার, ডেইজি, সিলভিয়া, এন্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, ডায়ান্থাস, ফ্লক্স, ভারবেনা, কারনেশান, পপি, সূর্যমুখী, পর্টুলেকা, ক্যালেন্ডুলা, হলিহক, মর্নিং গ্লোরি, সুইট পি, অ্যাজালিয়া, জারবেরা, গ্ল্যাডিওলাস পিটুনিয়া অন্যতম। বারান্দা বা গ্রিলে ঝোলানো টবে লাগানোর জন্য পিটুনিয়া, ন্যাস্টারশিয়াস, অ্যাস্টার, ভারবেনা ইত্যাদি উত্তম। গ্রিলে লতিয়ে দেওয়ার জন্য নীলমণি লতা, মর্নিং গ্লোরি, রেল লতা, সুইট পি ভালো। এসব ফুলের রূপ সৌন্দর্য, পরশ মানুষের মনে স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয়।
শীত মানেই হরেক রকম ফলের বাহার। শীত ঋতুর কমলা, কুল, সফেদা, জলপাই ইত্যাদি ফল মুখের স্বাদকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। এ ঋতুর জনপ্রিয় ফলগুলোর একটি ডালিম। এ ফল কারো কাছে বেদানা, কারো কাছে আনার নামে পরিচিত। শীতের ফলের রাজা বলা হয় কমলাকে। বর্তমানে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে কমলার চাষ হয়। এ ঋতুতে আরো যেসব সুস্বাদু ও উপকারী ফল পাওয়া যায় তার মধ্যে কুল, জলপাই, আমলকী অন্যতম।
শীতকালে গ্রামের মজাই আলাদা। শীত এলে বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে যায়। বাংলার শীতকাল আর পিঠা যেন একসূত্রে গাথা। কৃষকের ঘরে হেমন্তে নতুন ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পিঠা তৈরির কাজ। চলতে থাকে তা পুরো শীতকালজুড়ে। বেশির ভাগ পিঠাই মিষ্টিপ্রধান, কিছু পিঠা ঝালজাতীয়। তবে যে পিঠাই তৈরি করা হোক না কেন, পিঠা তৈরির মূল উপকরণ চালের গুঁড়া। এক এক অঞ্চলে এক এক রকমের পিঠা তৈরি হয়। একই পিঠার নামও আবার অঞ্চলভেদে ভিন্ন।
এমন কিছু পিঠা আছে, যা দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বানানো হয়। যেমন- চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, পুলিপিঠা, নকশিপিঠা, তেলেপিঠা ইত্যাদি। শীতকালীন পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পিঠাগুলো হলোÑ চিতই, পাকান, পাটিসাপটা, ভাপা, পুলি, ম্যারা, তেলেভাজা, ফুলঝুরি, নকশি, গোলাপফুল, দুধপিঠা, লাউ পায়েস, ছিট পিঠা, সিদ্ধ পিঠা, পুতুল পিঠা, লরি পিঠা, তারাজোড়া, জামাই পিঠা, ঝুরি পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, খান্দেশা, পিঠা, পাতা পিঠা, গুলগুলা, লবঙ্গ পিঠা, ক্ষীরডুবি, খাস্তা পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, মালভোগ, ক্ষীরকুলি, মালাই পিঠা, নারকেল ভাজা পুলি, নারকেল সিদ্ধ পুলি, নারকেল ঝুরি পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝাল পিঠা, বিস্কুট পিঠা, খাস্তা পিঠা, গজা, রুটি পিঠা, দুধ পায়েস, কুলি পিঠা, দুধকুলি পিঠা, জামাই কুলি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, চুটকি পিঠা, রসপুলি, মুরালি পিঠা, খান্দাশ, পয়সা পিঠা, চুষি পিঠা ইত্যাদি অন্যতম।
তুলনামূলকভাবে শীত নিয়ে গানে কাজ হয়েছে কম। তবুও কিছু গান আমাদের উষ্ণতার সঙ্গী।
শীতের হাওয়া
শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে
পাতাগুলি শির্শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে॥
উড়িয়ে দেবার মাতন এসে কাঙাল তারে করল শেষে,
তখন তাহার ফলের বাহার রইল না আর অন্তরালে॥
শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা
তারি লাগি রইনু বসে সকল বেলা।
শীতের পরশ থেকে থেকে
যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে,
সব খোওয়াবার সময় আমার হবে কখন কোন্ সকালে॥
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এটি। তাঁর তুলনা যে তিনিই, এই শীতের গানটিও সেই উজ্জ্বল উদাহরণ।
পৌষ এলো গো
পৌষ এলো গো,
পৌষ এলো
পৌষ এলো
অশ্রু পাথার হিম পারাবার পারায়ে
ওই যে এল গো।
কাজী নজরুল ইসলামের এই গানেও শীতের অপূর্ব বর্ণনা উঠে এসেছে।
শিশির ভেজানো রাতে
শিশির ভেজানো রাতে
বস্ত্রবিহীন কোনও ক্ষেত মজুরের
ভেঙে পড়া কুটিরের
ধিকিধিকি জ্বলে থাকা
তুষে ঢাকা আগুনের
রক্তিম যেন এক উত্তাপ হই।
ভুপেন হাজারিকার এই গানে মূলত শীতের কঠিন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। এই গান যেন শীতের দুর্ভোগে বিপন্ন মানুষের কথাই বলেছে।
পৌষের কাছাকাছি
পৌষের কাছাকাছি, রোদ মাখা সেই দিন
ফিরে আর আসবে কি কখনো?
ফিরে আর আসবে কি কখনো?
খুশি আর লজ্জার মাঝামাঝি সেই হাসি
তুমি আর হাসবে কি কখনো?
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ও প্রভাস দে’র সুরে এই গান গেয়েছিলেন মান্না দে। সেই থেকে এই গান শীতকালের।
শীতের সকালে
হিমেল ভোরে ভাসে
কুয়াশারই মেঘ জড়িয়ে রাখে
তার আঁচলে
ধীরে ধীরে হেসে ছড়িয়ে পড়ে
দিনের আলো শীতের সকালে।
শিশির ভেজা মাঠ পেরিয়ে
নবীন রোদের ধারা আসে
ভেসে গাঁয়ের মাঠে
মৃদু রোদে প্রানের সারা যেন
ওঠে জেগে
রাতের স্মৃতি হারায় আড়ালে
ধীরে ধীরে হেসে ছড়িয়ে পড়ে
দিনের আলো শীতের সকালে।
গানটি উইনিং ব্যান্ড এর । তাঁদের অচেনা শহরে শিরোনামের অ্যালবামে এই গান স্থান পেয়েছিল। জনপ্রিয় গানের তালিকাতেও আছে শীতকালিন এই গান।
শীত পড়েছে
জানালার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে
বাহিরে থমথম
গা ছমছম
ঝুপ করে শীত পড়েছে সাঁঝে।
রাজীব আহমেদের কথা ও শ্রী প্রীতমের সুরে আসিফ আকবর গেয়েছেন এই শীতকালীন গান। গানে শীতের বর্ণনাই প্রাধান্য পেয়েছে।
শীতের অবসরে
একটা দীর্ঘ শীতের অবসরে
বন্ধু আমি তোমায় যদি পাই
বারান্দাতে রোদ শুকাতে দেব
বলব তখন ছুটির গল্পটাই।
শীতের বনে
শীতের বনে কোন্ সে কঠিন আসবে ব’লে
শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে॥
আম্লকি-ডাল সাজল কাঙাল, খসিয়ে দিল পল্লবজাল,
কাশের হাসি হাওয়ায় ভাসি যায় সে চলে॥
সইবে না সে পাতায় ঘাসে চঞ্চলতা
তাই তো আপন রঙ ঘুচালো ঝুম্কোলতা।
উত্তরবায় জানায় শাসন, পাতল তপের শুষ্ক আসন,
সাজ-খসাবার হায় এই লীলা কার অট্টরোলে॥
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রকৃতি হতে সংগ্রহীত)
(সংস্করণ ১ – মান্না দে / Version 1 – Manna Dey)
শীত কেন্দ্রিক এই গান লিখেছেন সেজুল হোসেন, নিজের সুরে গেয়েছেন লুৎফর হাসান। আমজাদ হোসেনের সঙ্গীতে এই গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছেন লুইপা।
শীত নিয়ে আরও অনেক গান আছে। আপাতত এখানকার কিছু গানে শীত খুঁজে নেয়া যাক।
আরও দেখুন:
