আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি – গানের ইতিহাস । গান সংগ্রহ

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি – এই গানটিকে প্রথমে কবিতা হিসেবে লিখেছিলেন আব্দুল গফফার চৌধুরী। পরে প্রখ্যাত সঙ্গীতকার আবদুল লতিফ সুরারোপ করে গান হিসেবে দাড় করান। এরপর সুরটিকে আরও সুন্দর করে তোলেন শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদ। এই গানটি যখন তিনি লিখেছিলেন তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর, ঢাকা কলেজ এর আইএ ক্লাসের ছাত্র। ২২ শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের লাঠিচার্জে আহত অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কবিতাটি লিখে শেষ করেন।

 

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি – আবদুল গাফফার চৌধুরী । গান সংগ্রহ

 

একুশের গান একটি বাংলা গান যাআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো হিসেবে সুপরিচিত (প্রথম চরণ দ্বারা)। এই গানের কথায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি ২১ তারিখে সংঘটিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ফুটে উঠেছে। সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গানটি রচনা করেন। প্রথমে আবদুল লতিফ গানটি সুরারোপ করেন। তবে পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের করা সুরটিই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে, ১৯৫৪ সালের প্রভাত ফেরীতে প্রথম গাওয়া হয় আলতাফ মাহমুদের সুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি এবং এটিই এখন গানটির প্রাতিষ্ঠানিক সুর। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করেন। বর্তমানে এই গানটি হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।

 

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি – গানের কথা

 

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি।

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা

শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,

দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী

দিন বদলের ক্রান্তি লগনে তবু তোরা পার পারি ?

না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

সেদিনো এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে

রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিলো হেসে;

পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেনো,

এমন সময ঝড় এলো এক, ঝড় এলো ক্ষ্যাপা বুনো।

সেই আঁধারে পশুদের মুখ চেনা

তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা

ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে

ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই বাংলার বুকে।

ওরা এদেশের নয়,

দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়-

ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি-

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি

আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী

আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে

জাগে মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে

দারুণ ক্রোধের আগুনে জ্বালবো ফেব্রুয়ারি

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

 

 

সুরকার আলতাফ মাহমুদ:

সংগীতে আলতাফ মাহমুদের হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত বেহালাবাদক সুরেন রায়ের কাছে। এরপর গণসংগীতে যাত্রা শুরু। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম প্রহরে পাকিস্তান স্বাধীন হলে তিনি পাকিস্তানবরণ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। তারও দুই বছর পরে বরিশালের অশ্বিনী কুমার টাউন হলে কৃষকদের এক সমাবেশে তিনি গেয়েছিলেন গণনাট্য সংঘের বিখ্যাত গান ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’।

আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন ১৯৫০ সালে। সে বছরই যোগ দিয়েছিলেন ধূমকেতু শিল্পী সংঘতে। সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদের যাত্রা শুরু হয় ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ গানটি দিয়ে। এই গানটির গীতিকার ছিলেন মোশাররফ উদ্দিন। সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদ অমরত্ব লাভ করেন ১৯৫৩ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বিখ্যাত একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি দিয়ে। অবশ্য এই গানটির তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সুরকার। প্রথমে এই গানটির সুর দিয়েছিলেন তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুরকার আব্দুল লতিফ।

সংগীত পরিচালক হিসেবে আলতাফ মাহমুদের যাত্রা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ’ প্রযোজিত নৃত্যনাট্য ‘কিষাণের কাহিনী’ ও ‘মজদুর’ এ সংগীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে। এরপরের বছরই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ে তার গাওয়া দুটি বিখ্যাত গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। গানগুলো গাওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছিল। গান দুটি ছিল ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা’, ও ‘ মোরা কি দুঃখে বাঁচিয়া রবো’। একসময় তিনি গড়লেন পাকিস্তান গণনাট্য সংঘ।

 

সুরকার আলতাফ মাহমুদ
সুরকার আলতাফ মাহমুদ

আলতাফ মাহমুদের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে করাচি থেকে। এই রেকর্ডের সুরকার গীতিকার দুটোই ছিলেন তিনি। তার আগে একবার অস্ট্রিয়া যেতে গিয়ে তার পাসপোর্ট বাতিল হয়েছিল, যার ফলে তাকে করাচিতে থাকতে হয়েছিলো। ১৯৬৫ সালে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দেবু ভট্টাচার্যের। এসময় উচ্চাঙ্গ সংগীতে তিনি তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ কাদের খাঁ’র কাছে। চলচ্চিত্রের গানে আলতাফ মাহমুদের হাতেখড়ি হয় নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘কার বৌ’ চলচ্চিত্র দিয়ে। সে বছরই তিনি জহির রায়হানের বিখ্যাত ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। একই বছর সুফিয়া কামালের মধ্যস্থতায় বিয়ে হয়েছিল তার। ৬৯’ এর গণ অভ্যুত্থানেও বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের ব্যানারে রাজপথের আন্দোলনে শামিল ছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

আলতাফ মাহমুদ ছিলেন গণমানুষের শিল্পী। প্রতিটি গণআন্দোলনে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মানুষের পাশে। সেসব আন্দোলনে গানই ছিল হাতিয়ার। গান করেছেন তিনি গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গঞ্জ থেকে বন্দর, নগরে, রাজপথে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই বরিশালে কৃষকদের জনসভায় ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’ গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যে যাত্রার সূচনা তারপর ‘একুশের গান’, ‘মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা’, ১৯৭০ এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর ‘এ ঝঞ্ঝা মোরা রুখবো’র মতো অসামান্য সব গানের মধ্য দিয়ে নাড়া দিয়েছিলেন মানব হৃদয়কে। আর তার অসীম ত্যাগের চির স্বাক্ষর তো আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধেই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসা হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম গোপন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তার সুরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অজস্র দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে নিরাপদে অস্ত্র রাখতো। তার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থও সংগ্রহ শুরু করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

৩০ আগস্ট ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদের ৩৭০, আউটার সার্কুলার রোড রাজারবাগের বাসায় যায়। ওই বাসা থেকে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আটক করা হয় আবুল বারাক আলভী, আলতাফ মাহমুদের চার শ্যালক লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ, খাইরুল আলম বিল্লাহসহ ছয় জনকে। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে তাদের উপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। মার্শাল কোর্টে যখন তাকে তোলা হলো তখন তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ছিল না। তিনি যেন বুঝেই গিয়েছিলেন তার গন্তব্য। তিনি বলেছিলেন – আমার সঙ্গে যারা এসেছে, আমি ছাড়া আর কেউই অস্ত্রের ব্যাপারে কিছু জানে না। তিনি নিজের প্রাণ দিয়ে সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

 

গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী:

আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন একজন বাংলাদেশী গ্রন্থকার, কলাম লেখক। তিনি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো-এর রচয়িতা। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয়বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৭ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে একুশে পদক ও ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী
আব্দুল গাফফার চৌধুরী

 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালালে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র। ঢাকা কলেজের ছাত্র ও দৈনিক সংবাদের অনুবাদক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলেন আহত ছাত্রদের দেখতে। তিনি যখন ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে ঢোকেন, দেখতে পান সেখানে পড়ে আছে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের মরদেহ।

১৪৪ ধারা ভেঙে যখন ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গণে আসে পুলিশ তখন গুলি চালায়। রফিকউদ্দিন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান এবং ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার মরদেহ পড়ে ছিল। ৬-৭ জন ভাষা আন্দোলন কর্মী তার মরদেহ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন।

রফিকউদ্দিনের মরদেহ দেখে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মনে হয়েছিল, এটি যেন তার আপন ভাইয়েরই রক্তমাখা মরদেহ। এ সময়ই তার মনের আল্পনায় ভেসে এসেছিল কবিতার ২টি ছত্র।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি’

হাসপাতালের বাইরে তখন ছাত্র-জনতার ভিড়। ঠিক তখনই বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের সঙ্গে দেখা হয় আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর। সৈয়দ আহমদ হোসেন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিছিলে ছিলেন?’ আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বললেন, ‘ছিলাম। কিন্তু গুলি শুরু হলে মেডিকেল হোস্টেলে চলে গেলাম। একটা মরদেহও দেখে এলাম বারান্দায়।’

একইসঙ্গে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী কবিতার প্রসঙ্গটিও বললেন। সৈয়দ আহমদ হোসেন কবিতার প্রথম ছত্র শুনে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর হাত চেপে বললেন, ‘খুব ভালো হয়েছে। এই কবিতাটির বাকি অংশ এখনই লিখে ফেলুন না।’

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী জবাবে বললেন, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি কবিতা লেখা যায়? হোস্টেলে ফিরে না হয় লিখব।’কিন্তু তর সইল না সৈয়দ আহমদ হোসেনের। তিনি বলেই ফেললেন, ‘হোস্টেলে ফিরতে তো দেরি হবে। হেঁটে আরমানিটোলা যদি যান পথেই কবিতাটি হারিয়ে যাবে। তারচেয়ে আমার সাইকেলটা নিয়ে রওনা দিন। জলদি পৌঁছতে পারবেন।’

এদিকে হোস্টেলে এসে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী জানলেন, খারাপ পরিস্থিতির জন্য কলেজ ও হোস্টেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাতের মধ্যেই হোস্টেল ছাড়তে হবে সবাইকে। কাপড় গোছাতে গিয়ে তিনি ভাবলেন, কবিতার একটা ব্যবস্থা করা উচিত। নয়তো পরে আর লেখা সম্ভব হবে না। তখন হোস্টেলে বসেই তিনি বেশ কয়েক লাইন লিখলেন।

হোস্টেল বন্ধ হয়ে যাবে বলে সেখান থেকে তিনি বেগমবাজারে অবস্থিত ঢাকা কলেজের অন্য একটি হোস্টেলে চলে গেলেন। সেই হোস্টেলের সুপার ছিলেন ঢাকা কলেজের দর্শনের অধ্যাপক সাইদুর রহমান। সাইদুর রহমানের ছেলে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শফিক রেহমান। শফিক রেহমানের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর। সেই সূত্রে সেদিন রাতে হোস্টেলের অতিথি নিবাসে শফিক রেহমানের সঙ্গে ছিলেন তিনি। রাতেই লেখা হলো কবিতাটির একাংশ।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মরণে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ইমামতিতে অনুষ্ঠিত হয় গায়েবি জানাজা। জানাজা শেষে জনতার মিছিল বের হয়। যেখানে ছিলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীও। মিছিলে আচমকা লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। লাঠিচার্জে আহত আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তার বন্ধু দাউদ খান মজলিশের সহযোগিতায় চলে যান গেণ্ডারিয়ায়। সেখানে ছিল দাউদ খান মজলিশের এক আত্মীয়ের বাসা। সেই বাসার চিলেকোঠায় লেখা হয়েছিল কবিতাটির আরেক অংশ। কিন্তু সেখানেও কবিতাটি লেখা সম্পন্ন হয়নি।

লাঠিচার্জে আহত আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেলে। হাসপাতালেই ফের সৈয়দ আহমদ হোসেনের সঙ্গে দেখা তার। সৈয়দ আহমদ হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবিতাটির শেষমেশ কী গতি হলো?’ আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বললেন, ‘হয়েছে কিছুটা।’ সৈয়দ আহমদ হোসেন তার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘আজকের মধ্যেই করে দিন। বিশেষ প্রয়োজন।’ তখন কবিতাটির বাকি অংশ লেখা শেষ করেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী।

একুশের গানের প্রথম কয়েক ছত্র প্রকাশিত হয়েছিল একুশের প্রথম লিফলেটে। লিফলেটের শিরোনাম ছিল ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী, শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব’। প্রায় ২-৩ হাজার লিফলেট ছাপানো হয়েছিল। উৎসাহী ছাত্ররাই এ লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেন। চকবাজার, নাজিরা বাজার এবং ঢাকার অন্য সব এলাকাতেও লিফলেটগুলো কর্মীদের মাধ্যমে ওইদিনই ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

লিফলেটে এই কবিতাটির কয়েক ছত্র প্রকাশিত হলেও তখন লেখকের নাম প্রকাশিত হয়নি। অবশ্য ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর নাম ও একুশের গান শিরোনামে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। একুশের গানে প্রথম সুর দিয়েছিলেন তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আব্দুল লতিফ। গানটি প্রথম গাওয়া হয় ১৯৫৩ সালের ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল গুলিস্তানের ব্রিটেনিকা হলে। যেখানে গানটি গেয়েছিলেন আব্দুল লতিফ এবং আতিকুল ইসলাম। পরে আব্দুল লতিফ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এটি গেয়েছিলেন।

ওই বছর ঢাকা কলেজের ছাত্ররা কলেজে শহীদ মিনার স্থাপনের সময় গানটি গেয়েছিলেন। এই গান গাওয়ার অভিযোগে কলেজ থেকে ১১ ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার করে সুরকার আব্দুল লতিফকে। পরে মওলানা ভাসানীর অনুরোধে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রতিবাদ জানালে ছাত্রদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় প্রশাসন।

১৯৫৪ সালে প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ গানটিতে সুরারোপ করেন। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরিতে আলতাফ মাহমুদের সুরে গাওয়া হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’। ধীরে ধীরে এই সুরটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

চলচ্চিত্রে প্রথম গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জহির রায়হানের কালজয়ী ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে। ধীরে ধীরে এই গানটি সমার্থক হয়ে উঠে ভাষা আন্দোলনের, হয়ে উঠে এক অনন্য দলিল। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় এই গানটির অবস্থান ছিল তৃতীয়। গানটি গাওয়া হয়েছে ইংরেজি, ফরাসি, জাপানি, হিন্দিসহ মোট ১২টি ভাষায়।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment