বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কওমি ভাই আরব বিশ্বের ভূমিকা কী ছিল? মনে আছে? নাকি জোর করে ভুলে যেতে চান ! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আরব বিশ্বের অবস্থান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চেয়েও জঘন্য ছিল। বাঙ্গালীদের তারা মুসলিম তো মনে করেই নি। বাঁচাবার মতো মানুষও মনে করেনি। আসুন সংক্ষেপে একবার দেখে আসি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সৌদি আরবের ভূমিকা:
সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার আগপর্যন্ত। এমনকি পাকিস্তানের গণহত্যাকে সমর্থন করেছে “জিহাদ-এ- ফি সাবিলিল্লাহ” বা “ধর্মরক্ষার যুদ্ধ” বলে। স্বাধীন হবার পরও বাংলাদেশীদের হজ্বে যাবার অনুমতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরদিন স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিশরের ভূমিকা :
এরা মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। মে-জুলাই মাস থেকে নিউট্রাল, ধরি মাছ না ছুঁই পানি। আগস্টে ভারত-রাশিয়ার সাথে তাদের বন্ধুত্ব চুক্তির পর তাদের অবস্থানও বদলে যায়। বাংলাদেশের প্রতি সরাসরি সমর্থন জ্ঞাপন না করলেও, নিজেদের কুটনৈতিক স্বার্থে দুই পক্ষকেই (পাকিস্তান-বাংলাদেশ) এই ক্রাইসিস সমাধানের আহ্বান জানায়। তবে বাংলাদেশকে সরাসরি স্বীকৃতি প্রদান করে নাই। অর্থাৎ ভারত-রাশিয়া বলয়ে আসার পরও তারা বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়ে ভোকাল হয়নি। কারণ তাদের মিত্র দেশ (জর্ডান, সৌদিআরব) পাকিস্তানের পক্ষে ছিল সরাসরি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জর্ডানের ভূমিকা :
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর জর্ডান-মিশর-সৌদিআরব এর কর্মকর্তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল পাকিস্তান। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ সমর্থন কোন পর্যায়ে ছিল সেটা অনুমান করা যায়। জর্ডানের হাই কমিশনার ৭১ সালের জুলাইতে ঢাকায় সফরে এসে বলে গিয়েছিলেন যে “ইউনাইটেড পাকিস্তানই মুসলিম দেশগুলোর শক্তি ধরে রাখবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।” তিনি পাকিস্তানের সামরিক অভিযানকে সরাসরি সমর্থন করে গণহত্যার খবরকে “ভারতীয় প্রোপাগান্ডা” বলে অভিহত করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইরাকের ভূমিকা :
ইরাকের সম্পর্ক ভালো ছিল রাশিয়ার সাথে। তাই বাংলাদেশের প্রতি তাদের সফট কর্নার ছিল, কারণ রাশিয়া ছিল বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধু। আবার পাকিস্তানের সাথেও তাদের সুসম্পর্ক ছিল। পাকিস্তানের গণহত্যাকে সরাসরি সমর্থন না করলেও তারা ২৮শে এপ্রিল এক তারবার্তায় জানায় যে “ইউনাইটেড পাকিস্তানকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তাদের সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্যোগটা ইরাক বোঝে”।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ফিলিস্তিন, পিএলও, ইয়াসির আরাফাতের ভূমিকা :
যখন প্রায় সমস্ত আরব বিশ্বের অবস্থান প্রত্যক্ষ ও পরেক্ষভাবে পাকিস্তানের পক্ষে, তখন বাংলাদেশ আশা করেছিল অন্তত: ফিলিস্তিন ও ইয়াসির আরাফাতের পিএলও বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে। কারণ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি অতীতেও পূর্বপাকিস্তানের মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন ছিল।
তারা কি করলো? তারা নীরবতার অবস্থান নিলো। একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না ইয়াসির আরাফাত। কারণ তারা ছিল শুরুতে প্রো-পাকিস্তান। কারণ হিসাবে বলা যায় পুরো আরব বিশ্ব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের পক্ষে। অন্যদিকে ইসরায়েল আনঅফিসিয়ালি ৭১ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ৭১ সালের ১৮ এপ্রিল এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনের মুফতি আজম ও আমিনুল হুসেইনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতকে নাক গলাইতে নিষেধ করেন। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের অবস্থান পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল।
তবে সেপ্টেম্বর ১৬-২৭ তারিখ, ১৯৭০ সালে একটা ঘটনা ঘটে যাকে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর বলে, যার রেশ ১৯৭১ সালের জুলাই পর্যন্ত থাকে। এই ঘটনাটিকে জর্ডানের সিভিল ওয়ারও বলা হয়। জর্ডানের রাজা ও ইয়াসির আরাফাতের দ্বন্দ। জর্ডান ও ফিলিস্তিনের এই অন্তর্দ্বন্দে পাকিস্তান তখন জর্ডানকে সমর্থন করে, যা ১৯৭১ সালের জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ফলে ফিলিস্তিনের অবস্থান এপ্রিল ১৯৭১ এ পাকিস্তানের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে বাংলাদেশের দিকে যায় জুলাই এর শেষে। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট একটু কষ্ট করে গুগল করে নিয়েন। লেখা আরো বড় করার ইচ্ছা নেই আমার।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লিবিয়ার ভূমিকা :
লিবিয়ার সমর্থন ছিল সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের লিবিয়ায় প্রাথমিক আশ্রয় দেবার ঘটনা তাদের অব্যাহত সমর্থনকে প্রমাণ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সিরিয়ার ভূমিকা :
সিরিয়ার অবস্থান ছিল মিশরের মত, কারণ সে ছিল মিশরের সাথে UAR কনফেডারেশনে। অর্থাৎ ধরি মাছ না ছুই পানি। তবে ভারতের কৃষিমন্ত্রী সিরিয়ায় সফর করার পরে তাদের অবস্থান কিছুটা বাংলাদেশের পক্ষে আসে এবং পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের সমালোচনা করে । তবুও অক্টোবরে জাতিসংঘে এক অফিসিয়াল বিবৃতিতে ইউনাইটেড পাকিস্তানের পক্ষেই তাদের অবস্থান ব্যক্ত করে।
যেখানে প্রায় পুরো আরববিশ্বের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন পাকিস্তানের পক্ষে, সেখানে ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার গঠনের পরে। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের জেলে বন্দী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন খন্দকার মোশতাক। ইসরায়েলের স্বীকৃতি তখন অস্বীকার করা হয় এবং বাংলাদেশ চেয়ে থাকে আরব বিশ্বের সমর্থনের দিকে চাতক পাখির মত। এমনকি ফিলিস্তিনও নিজেদের স্বার্থে আঘাত না লাগা পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে টু শব্দটাও করেনি।
যে দেশ আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, যে দেশগুলো সেই হত্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছে, তাও আবার এমন সমর্থন যা আমেরিকার সমর্থনের চেয়েও জঘন্য, তাদের সবাইকে আমরা ধর্মভাই বলে বুকে ডাকি। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল, প্রত্যাখান করার পরেও যারা ভারতের শরনার্থী শিবিরে অর্থ সাহায্য দিয়েছিল, তাদেরকে আমরা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ৫০ বছর ধরে ব্যান করে রাখি।
আরব বিশ্বের পাকিস্তানকে দেয়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন ও ইনডেমনিটি দেয়া না থাকলে হয়তো ৯ মাস ধরে ৩০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হতো না, ২-৪ ল ক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হতো না। আরববিশ্ব হ্যাশট্যাগ বিপ্লব করে ১০ দিনেই হয়তো যুদ্ধবিরতি দিতে বাধ্য করতে পারতো, একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করতে পারতো।
#Diary বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কওমি ভাই আরব বিশ্বের ভূমিকা কী ছিল?
আরও পড়ুন: