আপনি ইমেইল করেন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। কথনও চাকরির আবেদন, কখনও ব্যবসার অফার বা কখনও ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কিং এর জন্য। কিন্তু অনেক সময় অনেক ছোট খাট ভুলের কারণে ইমেইল রিসিপিয়েন্ট বা প্রাপক আপনার উপরে বিরক্ত হতে পারে। কাজটা হবার বদলে সম্পর্কটা আগের চেয়ে তিক্ত হতে পারে। যে ভুলগুলো আমাকে বিরক্ত করে বা যেগুলো নিয়ে লোককে কথা বলতে শুনেছি, তার একটি তালিকা তুলে দিলাম।
১৩ টি গুরুত্বপূর্ণ ইমেইল শিষ্টাচার [ 13 Important Email Etiquette ] :
১. ইমেইল একাউন্ট এর নাম:
– From: ‘ফুল, পাথি, লতা, পাতা’ জাতিয় ইমেইল ঠিকানা পেশাজীবীদের ভীষণ বিরক্তির উদ্রেক করে। এরকম কোন মেইল ঠিকানা থেকে কাজের মেইল পাঠালে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি।
– আপনার পুরো নাম ব্যবহার করে মেইল একাউন্টে খুলুন। প্রতিষ্টানিক ডোমেইনের একাউন্ট হলে শেষ নামের যায়গায় কোম্পানি নাম ব্যবহার করতে পারেন। আর আপনি যদি প্রতিষ্ঠানের নামের কমন ইমেইল ব্যবহার করেন, তবে সেটা যেন প্রতিষ্ঠানের পুরো নামে হয়।
– ইংরেজিতে লিখলে কেস (বড় ছোট হাতের লেখা) খেয়াল করুন। আপনার নাম ছোট হাতের লেখা দিয়ে শুরু হলে শুরুতেই শেষ।
২. ইমেইলের ভাষা:
– আপনি এবং প্রাপক, দুজনে যেই ভাষাটি সবচেয়ে ভালো জানেন, সেই ভাষাতে ইমেইল লিখুন। আপনাদের দুজনের মাতৃভাষা যদি এক হয় তবে সেটাতেই লেখা ভালো।
– আপনি নিশ্চিত থাকুন, ভুলভাল বিদেশি ভাষায় লেখার চেয়ে, নির্ভুল দেশি ভাষায় লেখা মেইলের কার্যকারিতা অনেক বেশি।
৩. ইমেইল লেখার জায়গা:
– ছোট মেইল হলে সরাসরি মেইল এডিটর খুলো লিখতে পারেন। বড় মেইল হলে অন্য কোন এডিটরে লিখে পরে মেইল বডিতে পেস্ট করে পাঠানো যেতে পারে।
– তবে মেইল পাঠাবার সকল প্রস্তুতি শেষ হবার আগে পর্যন্ত To এর জায়গায় গ্রাহকের ঠিকানা না লেখা ভালো। কারণ ভুল করে অর্ধেক লেখা মেইল চলে যেতে পারে।
৪. ইমেইলের সাবজেক্ট বা বিষয়:
– সাবজেক্ট ছাড়া ইমেইল পাঠানোটা সবচেয়ে বড় ভুল। একে তো সাবজেক্ট ছাড়া মেইল জাঙ্ক বাক্সে চলে যেতে পারে। জাঙ্ক বাক্সে না গেলেও প্রাপকের বিরক্তির কারণ হবে। অনেকেই সাবজেক্ট না পড়ে মেইলে ক্লিকই করেন না। সেক্ষেত্রে আপনার মেইলের ঠিকানা হবে অপঠিত অবস্থায় ট্র্যাশ ফোল্ডার।
– সাবজেক্ট লিখুন সংক্ষেপে। যেই ৩টি শব্দ দিয়েই মেইলের বিষয়টি আঁচ করা যায়, এরকম শব্দ ৩ টি প্রথমে লিখুন। হেলো, থ্যাংকস, টাইপ শব্দগুলো সাবজেক্টে লিখবেন না।
– আপনার গ্রাহক যদি কম্পিউটারে মেইলটি পড়ে বলে মনে করেন, তবে সাবজেক্ট ৬০ বর্ণের মধ্যে লিখুন। যদি মোবাইলে পড়ে তবে বর্ণ সংখ্যা ৩০ এর উপরে যাবেন না। তবে গ্রাহক মোবাইলে পড়বে এরকম ভেবে পাঠানো সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ বিশ্বব্যাপী ৬০% ইমেইল প্রথম বার পড়া হচ্ছে এখন মোবাইলে।
৫. সম্বোধন:
– মার্জিত সম্বোধন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
– অন্য কিছু যদি খুঁজে না পান তবে ডেয়ার স্যার ম্যাডামের মধ্যে সিমাবব্ধ থাকুন। কোন ভাবেই সম্বোধন ছাড়া মেইল শুরু করবেন না।
৬. ইমেইলের বডি:
– সম্বোধনের পরে আপনার যা বক্তব্য তা এখানে গুছিয়ে লিখতে হবে। এখানেও মনে রাখতে হবে সংক্ষেপে। লম্বা আলাপ দেখা হওয়া বা অবসরে টেলিফোনে সারার জন্য রেখে দিন। কোন নতুন বিষয় হলে, পটভূমি একটা প্যারাগ্রাফে লিখুন। পটভূমি লেখার জন্য ৫ টি বাক্যর বেশি ব্যবহার না করা ভালো। যুক্ত বাক্য হলে সংখ্যা কমবে। অনেক বড় পটভূমি পাঠক এর বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির কারণ। পটভূমি বুঝতে বিস্তারিত তথ্যের প্রয়োজন হলে ফাইলে সংযুক্ত হিসেবে দিন। বডিতে দেবেন না।
– যদি অনেকগুলো বিষয় এক মেইলে জানানোর প্রয়োজন থাকে, তবে নম্বর দিয়ে পয়েন্টে করে লিখুন।
– প্রাপক এর কাছ থেকে কি চাচ্ছেন, সেটা তার পরের প্যারাগ্রাফে লিখুন। সম্ভব হলে এক বাক্যে। এক বাক্যে লিখতে না পারলে প্রধান একশন পয়েন্ট হাইলাইট করে দিন। তার পরে আবার পটভূমির কোন কথা টানবেন না।
– কোন নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে যদি প্রাপক এর কাছ থেকে আপনি কোন একশন আশা করেন, তবে তার জন্য আলাদা প্যারাগ্রাফে আর একটি লাইন লিখুন। তারিখের ফরমেট টা এমন ভাবে লিখুন যেন তিনি সহজে চাইলে ক্যালেন্ডারে যোগ করে নিতে পারেন।
– আপনি যদি মেইলের সাথে কোন ডকুমেন্ট যুক্ত করতে চান তবে এর পরে সংযুক্ত লিখে ক্রমানুসারে সেসব ফাইলের বিষয়বস্তু ও ফাইলের নাম লিখুন। প্রথমে ক্রমিক, তারপরে বিষয়, তার পরে ফাইলের নাম।
– এরপরে ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করুন। ধন্যবাদের পরে আপনার সিগনেচার। এছাড়া আর কিছু লিখবেন না।
৭. ইমেইল সিগনেচার:
– মেইলের শেষ অংশে যাবে আপনার সিগনেচার। আপনি প্রতিটি মেইলে আলাদা করে লিখতে পারেন বা একবারে টেম্পলেট বানিয়ে রাখতে পারেন যেন নতুন মেইল লেখা শুরু করলেই স্বয়ংক্রীয় ভাবে সিগনেচার বসে যায়।
– সিগনেচারের প্রথম লাইনে মেইল বডি থেকে আলাদা করার জন্য ……. ব্যবহার করতে পারেন। না করলে দুটো খালি লাইন ছাড়ুন। এরপরে আপনার নাম লিখুন। নামের নিচে আপনার প্রতিষ্ঠানে আপনার পদবী ও প্রতিষ্ঠানের নাম লিখুন। এরপর ফোন নম্বর ঠিকানা ইত্যাদি। একটি বিজনেস কার্ডে যেসব তথ্য থাকে সেগুলো সিগনেচারে থাকা ভালো। তবে সেগুলো যেন অবশ্যই গোছানো থাকে।
৮. ইমেইল পাঠাবার প্রস্তুতি:
– বানানগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন। সন্দেহ থাকলে সার্চ করে নিশ্চিত হন। যতটা সম্ভব বানান নির্ভুল হওয়া দরকার। বানান বিষয়ে সন্তুষ্ট হবার পরে পুরো মেইলটি শব্দ করে একবার পড়ুন। সম্ভব হলে একটু হেটে এসে আর একবার পড়ুন। তার পরে পাঠাবার জন্য চূড়ান্ত করুন।
– আপনি ভীষণ আবেগে, রাগে বা দুঃখে কাউকে মেইলটি লিখে থাকেন, তবে ড্রাফট অবস্থায় রেখে অবশ্যই বাইরে গিয়ে একাধিকার ঘুরো আসুন। কারণ আবেগে মানুষ অনেক সময় অনেক কিছু না লিখেও লাইনের মাঝে আছে বলে ভেবে নেয়। তাই ইমোশনালি চার্জড অবস্থায় ইমেইল লেখার বিষয়ে বিশেষ সাবধান হোন।
৯. মেইল এটাচমেন্ট:
– আগে যোগাযোগ ছাড়া কোন জিপ সংযুক্তি পাঠাবেন না।
– এটাচমেন্ট পাঠাবার আগে চিন্তা করুন গ্রাহক এর কম্পিউটারে খোলার উপযোগী সফটওয়ার থাকার সম্ভাবনা কতটুকু। এসব ক্ষেত্রে কমন ও ফ্রি ফরম্যাটে পাঠানো সবচেয়ে ভালো, যেমন পিডিএফ। ছবি পাঠালে আকার ছোট করে, জেপিজি’র মতো কোন একটা কমন ফর্মেটে পাঠান।
– একটা মেইলে অনেক বেশি এটাচমেন্টের বদলে একাধিক মেইলে এটাচমেন্ট পাঠানো ভালো।
১০. এবার পাঠানো:
– মেইল পাঠানো ঠিক আগে প্রাপক এর ঠিকানাটি লিখুন।
– পাঠকের ঠিকানা লেখার সময় খেয়াল করুন, আপনার এড্রেস বুকে তার নামটি কি নামে সেভ করা আছে। আমরা অনেক সময় আনঅফিসিয়াল নাম দিয়ে এড্রেস বুকে এন্ট্রি করি। সেই নামটি মেইলে গেলে হয়ত প্রাপক পছন্দ করবেন না। সেক্ষেত্রে মেইল পাঠাবার আগে সঠিকভাবে এডিট করে নিন।
– আপনি যে পাঠক বা যাদের কাছ থেকে কোন একশন আশা করছেন শুধুমাত্র তার/তাদের ঠিকানা “টু” তে লিখুন।
– সব শেষে একবার স্ক্রল করে সব ঠিক আছে কি না দেখুন। এরপর সেন্ড বাটন এ ক্লিক করুন।
১১. সিসি, বিসিসি:
– আপনার মেইলের বিষয়টি যাদের নোটিশে থাকা দরকার মনে করেন শুধুমাত্র তাদেরকে কপি দিন, মানে “সিসি” তে রাখুন।
– চিন্তা করে কপি দিন। অকারণ কপি দেয়া লোককে, লোকে সিরিয়াসলি নিতে চায় না।
– বিসিসি জিনিসটি খুবই সেনসিটিভ। সকল প্রাপক এর জানার অধিকার আছে যে এই মেইলটির কপি কে কে পেলো। তাই খুব জরুরী না হলে বিসিসি’র ব্যবহার করবেন না।
১২. রিপ্লাই:
– মেইল রিপ্লাই দেবার আগে মেইলটি ভালোভাবে পড়ুন। আপনার রিপ্লাই মনে মনে তৈরি করে নিন। এরপর রিপ্লাই দিতে বসুন। বড় রিপ্লাই দেবার প্রয়োজন হলে অন্য কোন এডিটরে আগে লিখে নিন। রিপ্লাই লেখার সুবিধার্থে ওই মেইলটি কপি করে এডিটরের উপরে পেস্ট করে দিতে পারেন।
– একই মেইলে অনেক গুলো বিষয় পয়েন্ট করে লেখা থাকলে ওই টেক্সট এর নিচে অন্য রং বা স্টাইলের টেক্সট এ রিপ্লাই লিখতে পারেন (টেকনিক্যাল সলিওশন মেইল অনেকসময় এভাবে লেখা ছাড়া উপায় থাকে না)।
– যদি আপনি ছাড়া অন্য কাউকে টু বা সিসি লিস্টে রাখা হয়, তবে আপনি অবশ্যই রিপ্লাই টু অল দিবেন। কারণ তারা রিলেটেড বলেই রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র প্রাপক কে পাঠাতে হলে তার কাছে আগে অনুমতি নিন।
– এক টপিকের মেইলে অন্য টপিক তুলবেন না। এটা অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং আপনার সম্পর্কে খুব নিচু ধারনা হবে।
১৩. ফরওয়ার্ড:
– মেইল ফরওয়ার্ড করার বিষয়ে সাবধান হন।
– কাউকে কোন মেইল ফরওয়ার্ড করলে, মেইলের শুরুতে কয়েক শব্দের মধ্যে লিখে বুঝিয়ে দিন যে আপনি তাকে কেন ফরওয়ার্ড করেছেন। মানে তার কি করনীয়।
শেষ কথা:
এত কিছুর পরেও যেসব কারণে আপনার মেইলের উত্তর নাও আসতে পারে বা আপনি অনাকাঙ্গিখত উত্তর পেতে পারেন:
– আপনি প্রাপক এর নামে বা তার কোম্পানির নামের বানান ভুল লিখেছেন।
– খুব বাহারি ফন্ট ও রংচং ব্যবহার করেছেন।
– আপনি মুখে বলা ভাষায় ইমেইল করেছেন, লেখার ভাষায় নয়। আপনি ভুলে গেছেন যে মুখে বলা ভাষা বোঝার জন্য সাথে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থাকে, লেখায় যেটা পুরোই অনুপস্থিত।
আপনার প্রতিটি ইমেইলের লক্ষ্য অর্জিত হোক।
শুভেচ্ছা !
আরও দেখুন:
- সুফি ফারুক এর পেশা পরামর্শ সভা
আমার এই লেখাটি নিয়ে করা গুরুকুল অনলাইন লার্নিং নেটওয়ার্ক এর ভিডিও: