আমার কাজী নজরুল ইসলাম নানা রকমের মানুষ। তার অনেক চেহারা, অনেক রূপ, অনেক রং। আজকের দিনে কবি চলে গিয়েছিলেন।
যখনই ভাবছি তখন মনে হচ্ছে :
খুশবু- ঘারছে মেরি যাতি নেহি, কুছ তো থি,
দো রোজ কি মেহমামে (এরকমই হয়তো ছিল লাইটা, ঠিক মনে নাই)
সেরকম কোন অতিথির আগমনে, আশপাশের সবকিছু হঠাৎ রঙ্গিন হয়ে ওঠে, সুরেলা হয়ে ওঠে। আজীবন শুধুই বাজতে থাকা সেতারটা – তার হাতে পড়ে যেন গেয়ে ওঠে। আজীবন ঠেকা ধরে রাখা মৃত চামড়ার তবলা – তার হাত লেগে রীতিমত আলাপ জুড়ে দেয়। সবাই সুর – বাজায়, গায়। আর তাঁর সুর – কাঁদে, হাসে, মান-অভিমান করে, দুরে যায়, কাছে আসে ….. শুনেছি – কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার সঙ্গীত-অঙ্গনের সেরকম অতিথি ছিলেন।
নজরুলের আকাশবাণীতে আসায়, পুরো আকাশবাণী হঠাৎ বদলে গিয়েছিল। কানে লাগার মতো সুরেলা হয়ে উঠেছিল রাতারাতি। সবাই যেন- সুরে ভাবছে, সুরে চলছে, সুরে গাচ্ছে, সুরে বাজাচ্ছে।
তিনি এসে প্রচলিত-অপ্রচলিত রাগগুলোর ব্যাবহার করে, আধুনিক ধারায় নতুন গান বাঁধা শুরু করলেন। নতুন নতুন রাগ তৈরি করলেন। গায়কিও বদলে দিলেন।
প্রতিটি প্রচলিত জনরা তে দুচারটি গান অন্তত যোগ করলেন, অনেকগুলোতে পুরো নতুন মাত্রা যোগ করলেন। শাস্ত্রীয় সংগীত, ভক্তিগীতি, ইসলামী গান, জাগরণী গান, গজল, শেয়ের, কাওয়ালী, লেটো, কোরাস, শ্রেনীসঙ্গীত, শোকগীতি, কীর্তন, ভজন, শিশুগীত, ঋতুগীত – কোথায় ছিলেন না তিনি।
যাদু দিয়ে রাঙ্গিয়ে দিলেন আকাশবাণী এবং ভবিষ্যতের বাংলা গানের পথকে।
আজ তার মহাপ্রয়াণ দিবস।
দোআ করি – তিনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন। সুরের ছায়ায়, সুরের মায়ায় থাকুন।
‘গাহি সাম্যের গান—/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্…’।
মানবতার জয়গানে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ছিলেন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন আপোষহীন। তার রচনায় ডাক দিয়ে গেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের। তিনি তাঁর কবিতার পঙক্তিমালায় তুলে ধরেন নিপীড়িত মানুষের কথা। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাংলা ভাষা ছাড়িয়ে বিশ্বসাহিত্যের জন্য এক মাইল ফলক। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে তিনি রচনা করেন তাঁর এই বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্ম।
বাংলা গানের বুলবুল তিনি। গান রচনায় ছিল তাঁর অসাধারণ প্রতিভা। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। তাঁর রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসঙ্গীত।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। ১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাজী নজরুল ইসলাম
সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন সব সময়। তিনি দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক লিখলেও মূলত ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসাবেই সমাদৃত।
কাজী নজরুল ইসলামের চার পুত্রের নাম ছিল যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ। আজকের দিনে যদি কোন বাবা তার সন্তানের নাম কৃষ্ণ মুহাম্মদ রাখতেন, তাহলে তার পরিণতি কি হত ভাবতেও ভয় হয়। অথচ অসামান্য অসাম্প্রদায়িক নজরুল আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেই এই সাহস দেখিয়েছিলেন, গোঁড়ামি বা নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ছোট করা বা অপমান করার অন্ধত্বের বিভেদ দূর করতে অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গেয়ে গেছেন যতক্ষণ পেরেছেন! তার “মানুষ” কবিতায় সেই অসামান্য দৃঢ় উচ্চারণ আজো কিংবদন্তীর মত জাজ্বল্যমান হয়ে আছে মহাকালের বুকেঃ
“…আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’
কোথা চেঙ্গিস্, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।…”
সবার উপরে মানুষকে সত্য প্রচার করায় তাকে তখনো নানা ধরনের নোংরামি আর কুৎসার শিকার হতে হয়েছিল, তবুও কপাল ভালো তিনি এ সময়ে জন্মাননি। তাহলে যে তাকে হয় মরতে হত বা দেশ ছেড়ে পালাতে হত জীবন বাচাতে!
আধুনিক সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য নাকি আস্তে আস্তে আমাদের আরো সভ্য হয়ে ওঠা, মানবিক ও সহনশীল উদার হয়ে ওঠা। কিন্তু আমরা সেগুলোর কোনটা তো হতে পারিইনি, বরং একজন অসাম্প্রদায়িক ‘মানুষ’ নজরুলের উত্তরসূরী হয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল হিসেবে সবার উপরে মানুষের বদলে উগ্র ধর্মান্ধতাকে সত্যি মেনে মানুষের উপর চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি করতে করতে সদলবলে এগিয়ে চলেছি এক আলকাতরার চেয়েও কালো বর্বর অন্ধকার সময়ের দিকে! 🙂
শুভ জন্মদিন প্রাণের কবি নজরুল, আলোর মশাল হাতে চলা আধাঁরের যাত্রী!
আরও দেখুৃন:
- কাজী নজরুল ইসলামের গান [ Songs of Kasi Nazrul Islam ]
- কাজী নজরুল ইসলামের বক্তৃতা [ Kasi Nazrul Islam’s Speeches ]
- কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা [ Poems of Kasi Nazrul Islam ]
- আমাদের গুরুকুল অনলাইন লার্নিং নেটওয়ার্কের আমার নজরুল প্রকল্পে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী [ সংক্ষিপ্ত ]
- কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি [ Brief biography of Kazi Nazrul Islam ]
- চলচ্চিত্রে নজরুল
105 thoughts on “আমার কাজী নজরুল ইসলাম”