১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন পাকিস্তানি সেনারা চারদিক থেকে পরাজিত হয়ে বুঝে যায় যে তাদের সমাপ্তি ঘনিয়ে এসেছে। তারা কেবল নিশ্চিত হতে চাইছিল, আত্মসমর্পণের পর যেন কোনো প্রতিশোধমূলক হত্যাযজ্ঞ না ঘটে।

সপ্তম নৌবহর: শীতল যুদ্ধের রাজনীতি
পাকিস্তানের প্রধান ভরসা ছিল আমেরিকার সপ্তম নৌবহর। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে তাদের সপ্তম নৌবহর পাঠায়, ostensibly to “protect American interests”, তবে মূলত পাকিস্তানকে সমর্থন ও ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর পাশে সোভিয়েত রণতরীর ২০টি যুদ্ধজাহাজ অবস্থান নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের কৌশলগত মিত্র, এবং দিল্লি-মস্কো চুক্তির ভিত্তিতে তারা ভারতকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। এই শক্তিশালী উপস্থিতির কারণে মার্কিন সপ্তম নৌবহর পিছু হটতে বাধ্য হয়। ফলে পাকিস্তানিদের শেষ আশা—মার্কিন সহায়তা—একেবারে শেষ হয়ে যায়।
এটি ছিল আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক ঐতিহাসিক মোড়: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ জোট একদিকে, অপরদিকে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমীকরণ। ১৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

রণাঙ্গনের পরিস্থিতি: ঢাকার অবরোধ
একাত্তরের এই দিনে দেশের অধিকাংশ রণাঙ্গনে বিজয়ের আনন্দ বইছিল। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ঢাকা কার্যত অচল হয়ে যায়।
স্থলে: মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি এবং মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলায় পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলো ভেঙে পড়ে।
আকাশে: ভারতীয় মিগ যুদ্ধবিমান ঢাকার পার্শ্ববর্তী সামরিক স্থাপনায় একের পর এক বোমাবর্ষণ চালায়।
জলে: নদীবেষ্টিত ভূপ্রকৃতির বাধা অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত অগ্রসর হয়।
এ অবস্থায় পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। জেনারেল মানেক শ’ তাঁকে সাফ জানিয়ে দেন—শুধু শর্তহীন আত্মসমর্পণই গ্রহণযোগ্য।

যুদ্ধবিরতির সময়সীমা
১৫ ডিসেম্বর বিকালে মিত্রবাহিনী সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে:
সন্ধ্যা ৫টা থেকে পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে।
পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করলে মিত্রবাহিনী প্রতিশোধমূলক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়াবে না।
কিন্তু সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়—যদি ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে আত্মসমর্পণ না হয়, তবে সর্বশক্তি নিয়ে আক্রমণ শুরু হবে।
ইয়াহিয়ার নির্দেশ ও নিয়াজির সম্মতি
নিয়াজি এ খবর তৎক্ষণাৎ ইসলামাবাদে জানালে, পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাতে নির্দেশ দেন—ভারতের দেওয়া আত্মসমর্পণের শর্ত মেনে নেওয়া হবে। নিয়াজি তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্ত মানেক শ’কে অবহিত করেন।
ফলে ১৫ ডিসেম্বর দিনটি মূলত চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি ও সময়-ক্ষণ নির্ধারণের মধ্য দিয়েই কেটে যায়।
সাভার থেকে ঢাকায় যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রা
রাতে যৌথ বাহিনী সাভার থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। পথে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
রাত ২টার দিকে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হয়।
প্রথমে কমান্ডো পদ্ধতিতে আক্রমণ চালানো হয়।
পাকিস্তানি সেনারা ব্রিজের অপর প্রান্ত থেকে তীব্র গোলাবর্ষণ করে।
তখন যৌথ বাহিনীর আরেকটি দল পশ্চিম পাড় থেকে আক্রমণ চালায়।
ফলাফল: সারা রাত তুমুল যুদ্ধ চলতে থাকে, ঢাকার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য
১৫ ডিসেম্বর শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মুক্তিযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের পিছু হটা এবং সোভিয়েত সমর্থন পাকিস্তানের মনোবল ভেঙে দেয়। এর পরদিনই আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ—১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানি সেনাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।
