গ্রাফিক্স ডিজাইনিং । পেশা পরিচিতি | পেশা পরামর্শ সভা

গ্রাফিক্স ডিজাইনিং । পেশা পরিচিতি | পেশা পরামর্শ সভা : সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের কাজের ধরন। সৃজনশীলতা দিয়ে সাজাচ্ছে কর্মজীবন। যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পেশা। সেখানে একটু আলাদাভাবে দেখাতে পারেন আপনার মেধা ও মননশীলতার উৎকর্ষতা। এভাবেই আপনি হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল পেশাজীবী। কর্মজীবনটা হয়ে উঠতে পারে সাফল্যের গল্প। আপনি আপনার সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের জীবনকে সাজিয়ে তুলতে পারেন গ্রাফিক্স-ডিজাইনের মাধ্যমে।

আত্মবিশ্বাস ও নান্দনিক শিল্পবোধ থাকলে যে কেউ এ পেশার মাধ্যমে নিজেকে সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে পারেন। বিশ্বজুড়ে দিন দিন গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। এটা একটা সম্মানজনক পেশাও। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অন্যতম একটি মাধ্যম হলো গ্রাফিক্স-ডিজাইন। একজন পেশাদার ডিজাইনার মাসে হাজার ডলারেরও বেশি আয় করতে পারেন। মার্কেটপ্লেস সাইটগুলোতে গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রচুর কাজ পাওয়া যায়। তাহলে ভেবে-চিন্তে নেমে পড়ুন গ্রাফিক্স-ডিজাইনে।

গ্রাফিক্স ডিজাইনিং, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, Graphics Design, Graphics Designer

অন্য সব চাকরি থেকে গ্রাফিক্স-ডিজাইন পেশাটি সবচেয়ে নিরাপদ ও ঝামেলাবিহীন। কারণ, ভালো ডিজাইন করতে পারলে কাজের অভাব হয় না। নারীদের জন্যও এটি একটি ভালো সেক্টর। বাংলাদেশের অনেক নারী অনলাইনে গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ করে প্রচুর উপার্জন করছেন।

গ্রাফিক্স ডিজাইন কী?

ডিজাইন শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। চিত্রলেখ বিষয়ক শিল্পকর্মকেই গ্রাফিক্স ডিজাইন বলা হয়ে থাকে। আর গ্রাফিক্স-ডিজাইন হলো, নকশা ব্যবহার করে সুন্দর ও মানসম্মত চিত্রকর্ম তৈরি করাকে গ্রাফিক্স- ডিজাইন বলা হয়। সহজ ভাবে বললে, প্রযুক্তি দ্বারা যে ডিজাইন তৈরি করা হয় তাকে গ্রাফিক্স ডিজাইন বলে। আরও সহজ করে যদি বললে কম্পিউটার ও বিভিন্ন সফটওয়্যারের সমন্বয়ের মাধ্যমে যে ডিজাইন তৈরি করা হয় তাকে গ্রাফিক্স-ডিজাইন বলে। যে কোনো কোম্পানির জন্য গ্রাফিক্স-ডিজাইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানির ভিজিটিং কার্ড, প্যাড, বিল, বিলবোর্ড, পণ্যের বিজ্ঞাপন, পণ্যের প্যাক ইত্যাদি কাজ হয় গ্রাফিক্স ডিজাইনের মাধ্যমে।

গ্রাফিক্স ডিজাইনার কে?

গ্রাফিক্স ডিজাইন হলো আর্ট বা শিল্প। ডিজাইনার তার কাজের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মধ্যে একটি ভালো প্রভাব ফেলতে পারেন। যেটি সেই ব্যবহারকারীর মস্তিষ্কে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। এর জন্য তিনি গ্রাহকের চাহিদানুযায়ী বেশ কিছু আর্ট, টাইপফেস, ইমেজ এবং অ্যানিমেশন ব্যবহার করে, তার চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। গ্রাফিক্স-ডিজাইনের আউটপুট ডিজিটাল বা প্রিন্ট উভয়ই হতে পারে। আর বর্তমান সময়ে সচরাচর পাওয়া বিভিন্ন টুলস ও লে-আউট ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাফিক্স ডিজাইনার তার কাজকে আরও বেশি ক্রিয়েটিভ ও গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি তৃপ্তি দিতে পারছেন।

সহজ ভাবে বললে, যিনি কম্পিউটার ও বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে তার সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তি দিয়ে কোনো ডিজাইন তৈরি করেন, তিনিই হলেন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত সময় উপযোগী গ্রাফিক্স-ডিজাইন সফটওয়্যার হচ্ছেÑ গ্রাফিক্স সম্পাদনাকারী সফটওয়্যার অ্যাডোবি ফটোশপ, ভেক্টর গ্রাফিক্স সম্পাদনাকারী সফটওয়্যার অ্যাডোবি ইলাস্ট্রেটর, ডেস্কটপ পাবলিশিং প্যাকেজ প্রোগ্রাম কোয়ার্ক এক্সপ্রেস ইত্যাদি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রাফিক্স ডিজাইনিং :

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে গ্রাফিক্স ডিজাইনারের চাহিদা ব্যাপক। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা অনুযায়ী চাকরির সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া নিজেও গ্রাফিক্স-ডিজাইন প্রতিষ্ঠান দিয়ে আত্মকর্মসংস্থান গড়ে তোলা যেতে পারে। লোকাল মার্কেট বা মার্কেটপ্লেস সাইটগুলোতে প্রতিনিয়ত গ্রাফিক্স-ডিজাইনের কাজের পরিমাণ বাড়ছে। একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনারের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে ইন্টার‍্যাক্টিভ মিডিয়া, প্রমোশনাল ডিসপ্লে, জার্নাল, কর্পোরেট রিপোর্টস, মার্কেটিং ব্রোশিউর, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, লোগো ডিজাইন, ওয়েবসাইট ডিজাইনসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে।

নিজেকে দক্ষ করতে পারলে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনারের কাজের অভাব হয় না! সম্প্রতি দেওয়া এক তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ গ্রাফিক্স ডিজাইনারের কাজ করে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী। তাই আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন, তাহলে মাত্র কয়েকমাসের ভিতরেই গ্রাফিক্স-ডিজাইন আয়ত্তে এনে নিজেকে বদলে দিতে পারেন। একজন ভালোমনের গ্রাফিক্স ডিজাইনার মাসে অনায়াসে ৫-৬ অঙ্কে উপার্জন করেন।

গ্রাফিক্স ডিজাইনিং এর কাজের ক্ষেত্র :

একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনারের দায়িত্ব হলো তার কাজ, পণ্য বা সেবার ওভার-অল লুক ও ভাবমূর্তি ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া ডিজাইন করতে গেলে যতই ভালো পণ্য হোক না কেন সেটি প্রথমেই বিফল হতেই হবে। তাই একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সৃজনশীলতাকে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনারের মানকে উন্নত করে। সাধারণত গ্রাফিক্স ডিজাইনার যা করে তা হলো- লোগো ডিজাইন, প্রোডাক্ট হলোগ্রাম ডিজাইন, ইমেজ রিসাইজ অ্যান্ড এডিটিং, স্কেচ তৈরি, ওয়েবসাইটের ডিজাইন, বিজনেস কার্ড, ব্যানার, পোস্টার, স্টিকার, মেমো, প্যাড, আইডি কার্ড, বিলবোর্ড, পণ্যের বিজ্ঞাপন, পণ্যের প্যাক, দাওয়াত কার্ড, সাইনবোর্ড, ম্যাগাজিন, লিফলেট ইত্যাদি। দেশীয় বাজারে ও মার্কেটপ্লেস সাইটগুলোতে প্রতিনিয়ত গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

গ্রাফিক্স ডিজাইনিং উদ্যোক্তা :

প্রচুর ওয়েবসাইট আছে যেখানে ডিজাইনের টেম্পলেট বিক্রি করা যায়। বড় বড় পূর্ণাঙ্গ ডিজাইনের সাথে সাথে এসব সাইটে অনেক ছোট ছোট ডিজাইনও বিক্রি করা যায়। একটি ওয়েবসাইট তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রাফিক্স যেমন বাটন, ব্যানার, বিভিন্ন ধরনের টেবিল, ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি তৈরি করেও বিক্রি করা যায়। বিভিন্ন শেপ, লোগো এবং কার্ড ছাড়াও আরও অনেক ধরনের ডিজাইন দেওয়া যায়। এ জন্য অনেক ভালোমনের ডিজাইন দিতে হবে এবং সেটা যদি সাইট কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয় এবং ডিজাইনটা মানসম্মত ও অন্য কোনো ডিজাইনের অনুকরণে না হয় তাহলেই তারা সেটা বিক্রির জন্য উন্মুক্ত করে দেবে। যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হলে তারাই ডিজাইনটির একটি মূল্য নির্ধারণ করে দিবে, এটি ১ ডলার থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।

এর মধ্যে প্রথম অবস্থায় ৪০ শতাংশ অর্থ ডিজাইনারকে দেওয়া হবে, ধীরে ধীরে সেটা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আবার ৯৯ ডিজাইনস সাইটেও ডিজাইন বিক্রি করা যায়, তবে তার জন্য কমপক্ষে একটি কন্টেন্টে বিজয়ী হতে হবে। একটি ডিজাইন যতবার বিক্রি হবে ডিজাইনার ততবার টাকা পাবে। গ্রাফিকরিভার ডটকমের গড় হিসাবে প্রতিটি ডিজাইন ১২০ থেকে ১৫০ বার বিক্রি হয়। এ হিসাবে একটি ডিজাইন ১৫ ডলার করে বিক্রি হলেও মোট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০০ ডলার থেকে শুরু করে ২ হাজার ৭০০ ডলার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্র একটি ডিজাইন বিক্রি করেও একেকজন ডিজাইনার আয় করেছেন ৫ থেকে ৭ হাজার ডলার পর্যন্ত।

গ্রাফিক্স ডিজাইনিং এ ক্যারিয়ার করার যোগ্যতা :

গ্রাফিক্স ডিজাইনার হতে গেলে শিক্ষাগতযোগ্যতা কোনো বিষয় নয়। এখানে মূলত কাজের দক্ষতাই প্রধান বিষয়। ক্রিয়েটিভিটি সফলতার উচ্চশিখরে নিয়ে যেতে পারে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনা করে, তাদের প্রত্যাশা মূলত গ্রাফিক্স ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা, ফাইন আর্টসে ব্যাচেলর ডিগ্রি বিষয়টি চান। তবে সব ক্ষেত্রেই তারা কাজের দক্ষতার বিষয়টি আগে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই, আগে কাজের ক্ষেত্রে যোগ্য হতে হবে। সবকিছুর জন্যই কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।

গ্রাফিক্স-ডিজাইন শেখার জন্যও আপনার কিছু যোগ্যতা থাকতে হবে –
• কম্পিউটার সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
• ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা
• গ্রাফিক্স-ডিজাইনের প্রতি আগ্রহ
• সৃষ্টিশীল মন
• ধৈর্য শক্তি
• পরিশ্রম করার মানসিকতা
• দক্ষতা, ক্রিয়েটিভ ভিশন এবং কমিউনিকেশন স্কিল ভালো করতে হবে।

গ্রাফিক্স ডিজাইনিং ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুতি :

বিভিন্নভাবে আপনি গ্রাফিক্স-ডিজাইন শিখতে পারেন –
• একজন দক্ষ ও ক্রিয়েটিভ ডিজাইনারের সাথে থেকে
• ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স-ডিজাইন সম্পর্কিত কোনো ডিগ্রি থাকা ভালো।
• ইউটিউব বা বিভিন্ন টিউটোরিয়াল ওয়েবসাইট থেকে দেখে টিউটোরিয়াল দেখে শেখা।
• একটা ভালো পোর্টফলিও তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে আপনি আপনার গ্রাহকদের কাছে • প্রফেশনাল দক্ষতাকে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন।
• গ্রাফিক্স-ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রির সর্বশেষ সংবাদ সম্পর্কে আপ-টু-ডেট থাকতে হবে।

গ্রাফিক্স ডিজাইনিং ক্যারিয়ারে আয়-রোজগার :

গ্রাফিক্স-ডিজাইন একটি ক্রিয়েটিভ পেশা। তাই কাজের মান ও ক্রিয়েটিভিটির ওপরই ভিত্তি করে আয় নির্ভর করে। সাধারণত শুরুতে ডিজাইনারদের মাসে ৮-১৫ হাজার টাকা। বিডিজবসের সূত্রানুসারে, বাংলাদেশে গ্রাফিক্স-ডিজাইনে ডিপ্লোমাধারীর বেতন মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তবে ব্যাচেলর ফাইন আর্টসে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারীদের বেতন মাসিক ৪০ হাজার টাকা থেকে ২-৩ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আয়টা আসলে নির্ভর করে ডিজাইনারের কাজের মানের উপরে। আন্তর্জাতিক মানে ডিজাইন করতে পারলে আয়ের পরিমাণটা অনেক বাড়বে।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ডিজাইনার স্যালারিজের মতে, একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার প্রতি বছরে গ্রাফিক্স-ডিজাইন বা এ সম্পর্কিত কাজ করে এক লক্ষ মার্কিন ডলার বা ৮০ লাখ টাকার বেশি আয় করতে পারে। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে একটি লোগো ডিজাইন করলে পাঁচ থেকে শুরু করে দুই হাজার মার্কিন ডলার বা তার বেশি পেতে উপার্জন করা সম্ভব। তবে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এটি পাঁচ থেকে ১০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্তও হতে পারে। একটি ওয়েবসাইটের ‘হোম পেজ’ ডিজাইন করার ক্ষেত্রে ৫০ মার্কিন ডলার থেকে শুরু করে ৩ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত পাওয়া যায়।

পূর্ণাঙ্গ একটি ওয়েবসাইটের ডিজাইন করে পাওয়া যায় ২০০ থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত। ব্র্যান্ড অপটিমাইজেশন এবং ব্রোশিউর তৈরির প্রজেক্টগুলোও ৩০০ থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে একজন ভালো মানের গ্রাফিক্স ডিজাইনার মার্কেটপ্লেসগুলো থেকে আয় করতে পারেন এক থেকে দেড় লাখ টাকা। এ ছাড়া ৯৯ ডিজাইনস ডটকম, ফ্রিল্যান্সার কনটেস্ট, ফাইভার, আপওয়ার্কসহ অনেক ওয়েবসাইট বা অনলাইন মার্কেটপ্লেস রয়েছে যেখানে এই ধরনের কাজ করা যায়।

আরও পড়ুন: