ডিজিটাল বাংলাদেশ: কীভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে শেখ হাসিনার অবিচল যাত্রাকে

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এক সমৃদ্ধ সোনার বাংলার। তাঁর আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবনের পথ রচনা করার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল।

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে নেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ তাঁর জীবনে এক ভয়ঙ্কর মোড় নিয়ে আসে—যখন তিনি পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হারিয়ে নির্বাসিত জীবন কাটাতে বাধ্য হন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। শুরু হয় তাঁর এক কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক যাত্রা—যা বারবার প্রাণনাশের হুমকি ও অগণিত বাধাবিপত্তিতে পূর্ণ ছিল। তবুও তিনি দমে যাননি, বরং অবিচল থেকেছেন এবং আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার হয়েছেন।

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনা বিকশিত হয়েছেন দূরদর্শী, গণতন্ত্র-নিষ্ঠ এবং জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল এক নেত্রী হিসেবে। পিতার আদর্শের প্রতি তাঁর অটল নিষ্ঠাই তাঁকে প্রতিকূলতম পথেও এগিয়ে যেতে শক্তি জুগিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি নিজের রাজনৈতিক যাত্রা এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের অভিযাত্রা নিয়ে গভীর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সেই প্রবন্ধে—“Striving to Realise the Ideals of My Father” (আমার পিতার আদর্শ বাস্তবায়নের প্রয়াস)—ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রাকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে চিহ্নিত করেন:

১. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের সংগ্রাম
২. জনগণের সাতটি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা ও নিরলস প্রচেষ্টা
৩. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধ, আধুনিক বাংলাদেশের প্রস্তুতি গ্রহণের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা

প্রবন্ধের শুরুতেই শেখ হাসিনা একটি হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বর্ণনা করেন, কীভাবে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর পরিবারকে সাধারণ মানুষের কষ্ট অনুভব করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই শিক্ষা-ই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বের ভিত্তি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি নির্ধারক বৈশিষ্ট্য

নিজ পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন—তিনি ছিলেন একেবারেই সাধারণ এক বাঙালি পরিবারের সন্তান; যেমন হাজারো মানুষ বাংলার গ্রামে-গঞ্জে বসবাস করে। কিন্তু তাঁর জীবনযাত্রা, মূল্যবোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলিই তাঁকে অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনা তিনটি বৈশিষ্ট্যকে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র ও নেতৃত্বের মূল সংজ্ঞা হিসেবে তুলে ধরেন—

প্রথমত, শেখ মুজিবের সহজাত সহানুভূতি ও মানবিকতা। তিনি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তুলতে পারতেন। গ্রামীণ কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা তাঁকে সাধারণ মানুষের কষ্ট অনুভব করতে শিখিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিঃসংকোচ ও নির্ভীক। জীবনের প্রতিটি ধাপে অবিচার, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে অবস্থান নিয়েছেন।

তৃতীয়ত, তাঁর ছিল অসাধারণ ভাষার দক্ষতা ও যোগাযোগ ক্ষমতা। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বঞ্চনার গল্পকে এমনভাবে ভাষায় রূপ দিতে পারতেন, যা লাখো হৃদয়ের সঙ্গে মিশে যেত। এই কারণেই তিনি শুধু রাজনৈতিক প্রতিনিধি নন, বরং হয়ে উঠেছিলেন সমগ্র জাতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিমূর্তি।

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই মাতৃভাষা বাংলার অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে নতুন সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের দাবিতে এক সমাবেশে অংশগ্রহণের সময় শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মীরা গ্রেপ্তার হন। সেটিই ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বারবার গ্রেপ্তার, কারাবাস ও নির্যাতনের প্রথম দিকের অধ্যায়।

ভাষা আন্দোলনের এই নেতৃত্ব তাঁকে ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত করে। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় তিনি আওয়ামী লীগকে রূপ দেন এমন এক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে, যেখানে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশা, ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ছিল।

প্রায় দুই দশকের নিরলস সংগ্রামের পর তিনি প্রথমবারের মতো সাত কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে, যখন জনগণ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে সমর্থন জানায় এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি আস্থা প্রকাশ করে।

কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই গণতান্ত্রিক রায়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এই ন্যায়সংগ্রাম ধীরে ধীরে রূপ নেয় স্বাধীনতার চূড়ান্ত আন্দোলনে।

মুক্তির ডাক ও স্বাধীনতার সূচনা

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ জাতিকে নতুন দিকনির্দেশনা দেয়:
“এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরীহ মানুষের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। এরই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হয় নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ। রক্ত ও আত্মত্যাগের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে, আর ১৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র—বাংলাদেশ।

এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ দুই দশকের অক্লান্ত সংগ্রামের পরম বাস্তবায়ন—একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়ভিত্তিক বাঙালির রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।

বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ: বাংলাদেশের যাত্রাপথে আলোকবর্তিকা

রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস পথেই তাঁর লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং একটি অজ্ঞাত স্থানে তাকে একাকী কারাবন্দি করে রাখা হয়।

এই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা লেখেন:

“কারাগারের অভ্যন্তরে এক গোপন সামরিক বিচারে আমার পিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মনে হচ্ছিল ফাঁসি অবধারিত। কিন্তু সেই সাজা কার্যকর হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

আমার বাবা প্রায়ই কারাগারে থাকতেন, ফলে আমরা ভাইবোনেরা তাঁর শারীরিক উপস্থিতি থেকে বঞ্চিত হয়েছি বহুবার—তবে তাঁর ভালোবাসা ও আদর্শ থেকে কখনও নয়। আমাদের মা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের পথচলায় পাশে ছিলেন, আর আমাদের পাশে ছিলেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হওয়ার জন্য। আমরা বাবাকে ভীষণ মিস করতাম, কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিই আমাদের তাঁর আদর্শে আরও নিবেদিত করেছিল।

আমরা সবসময় জানতাম, কেন তিনি আমাদের কাছে নেই—কারণ তিনি ছিলেন দেশের স্বাধীনতার বৃহত্তর স্বার্থে নিবেদিত। তাঁর ত্যাগ আমাদেরকেও ত্যাগের প্রেরণা জুগিয়েছে।

আমাদের দুই অভিভাবকই আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বপন করেছেন। আমরা বাবার মতোই মানুষকে ভালোবাসতাম, আর তাঁর মতোই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলাম। তাঁদের দীক্ষা আমাদের সাহায্য করেছে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকতে।

অসীম বাধা পেরিয়ে: ‘সোনার বাংলা প্রথম পদক্ষেপ

শেখ হাসিনা তাঁর পিতার ফিরে আসার সেই স্মরণীয় মুহূর্তটি স্মরণ করে লেখেন—

“বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমার বাবাকে অবশেষে মুক্তি দেয়। তিনি বিজয়ী বেশে ঢাকায় ফিরে আসেন, যেখানে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ তাঁকে অপরিসীম ভালোবাসা ও উল্লাসের সঙ্গে স্বাগত জানায়।”

নবগঠিত সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। চ্যালেঞ্জগুলো ছিল তাৎক্ষণিক ও ব্যাপক—

  • জাতীয় কোষাগার ছিল সম্পূর্ণ খালি।
  • ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটিরও বেশি শরণার্থী দেশে ফিরে আসছিল, যাঁদের পুনর্বাসনের জন্য জরুরি পদক্ষেপ দরকার ছিল।
  • রাস্তা, রেলপথ, সেতু এবং প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল এবং সেগুলো পুনর্গঠন করতে হতো।
  • মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রধারণকারী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে হতো।
  • আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হতো।

এর পাশাপাশি, যুদ্ধে বিপর্যস্ত কৃষি খাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে হতো এবং ফসল উৎপাদন চালিয়ে যেতে কৃষি উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হতো।

এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যেই বঙ্গবন্ধু একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেন, যার লক্ষ্য ছিল একটি সর্বাঙ্গীণ জাতীয় পুনর্গঠনের রূপরেখা তৈরি করা। তাঁর অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল একটি সংবিধান প্রণয়ন, যা হবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা, আত্মত্যাগ ও স্বাধীনতার স্বপ্নের প্রকৃত প্রতিফলন।

একই সঙ্গে শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অভিযানে নেমে পড়েন বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে। অভূতপূর্ব দ্রুততার সঙ্গে তিনি প্রতিবেশী ও বিশ্বশক্তিসমূহের সমর্থন অর্জন করেন। তাঁর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ও দূরদৃষ্টি তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সম্মানিত রাষ্ট্রনায়কে পরিণত করে।

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ঢাকায় আসেন, এবং শেখ মুজিব আমন্ত্রণ পান বিশ্বের রাজধানীগুলিতে। স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর একটি ছিল ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, যখন তিনি নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। তাঁর জোরালো বক্তব্যে প্রতিটি বাংলাদেশি গর্বে বুক ফুলিয়ে ওঠে—এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি সম্মান ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের উপস্থিতি জানান দেন।

তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধা অর্জন করে—এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটি হয়ে ওঠে আশার, সংগ্রামের ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক।

 

১৯৭৫এর শোকাবহ অধ্যায় শেখ হাসিনার নির্বাসিত জীবন

১৯৭৫ সালের সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা লেখেন—

“সেই ভয়ঙ্কর দিনের বিশালতা আমি কখনোই পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারিনি। তখন আমি, আমার ছোট বোন রেহানা এবং আমার দুই সন্তান জার্মানিতে ছিলাম, যেখানে আমার স্বামী ড. ওয়াজেদ একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতেন। বেলজিয়ামে এক সংক্ষিপ্ত সফরের সময়, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ভোরে, তীব্র টেলিফোন রিংয়ে ঘুম ভেঙে যায়।

আমাদের আতিথেয়তাকারী ফোন ধরে কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন না—শুধু আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বললেন। আমার স্বামী তখন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমার দিকে ফিরে শুধু বললেন, ‘বাংলাদেশে একটি কূপ হয়েছে।’ কিন্তু আমি তাঁর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, ঢাকায় আমার পরিবারের সঙ্গে ভয়ানক কিছু ঘটেছে।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম; প্রথম যে কথাটি বলেছিলাম তা ছিল, ‘যদি কূপ হয়ে থাকে, তবে আমি সবাইকে হারিয়েছি।’

পরবর্তীতে আমরা বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসভবনে পৌঁছালে সেই হৃদয়বিদারক সংবাদ পাই: আমার বাবা, মা, সদ্য বিবাহিত দুই ভাই এবং তাঁদের স্ত্রীরা, এমনকি আমার ছোট ভাই রাসেল—সবাই নিহত হয়েছেন। আমার পরিবারের ১৮ জন ঘনিষ্ঠ সদস্যের নাম একত্রে বলতে গিয়েই বুকটা ফেটে যায়।”

এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর, হত্যাকারীরা শেখ হাসিনা ও তাঁর বোনকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি দেয়নি। দুই শিশু সন্তানসহ তাঁকে দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর কঠিন নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। শরণার্থীর মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়, সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়েছে—কোন মুহূর্তে খুনি চক্র এসে জীবন নিয়ে যাবে এই আশঙ্কায়।

 

বিপদের মাঝেও বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যাবর্তন

পাঁচ বছরের নির্বাসনের পর শেখ হাসিনা সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন—বাংলাদেশে ফিরে আসার। তিনি স্মরণ করেন:

“অবশেষে আমরা অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে একটু আলো দেখতে পেলাম। সীমিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ—যে দলটি আমার পিতা পঞ্চাশের দশক থেকে লালন-পালন করেছিলেন—আমাকে সভাপতি নিযুক্ত করল। জনগণ এই সিদ্ধান্ত আন্তরিকভাবে গ্রহণ করল।

১৯৮১ সালে আমি দেশে ফিরে আসি, যদিও সে সময় সামরিক শাসন ক্ষমতায় ছিল এবং তারা আমার প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতা করছিল।”

তবে এই প্রত্যাবর্তন কোনো মসৃণ রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা ছিল না। প্রতিটি মোড়ে তাকে মোকাবেলা করতে হয়েছে চ্যালেঞ্জ, ট্রমা, এবং বিশৃঙ্খলার। অটল এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শেখ হাসিনা এই কঠিন পথেই সমস্ত শক্তি এবং আবেগ দিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস ছিল—এই পথেই চলতে হতো, যেমনটি বঙ্গবন্ধু করতেন।

তিনি অনুভব করেছিলেন, এইসব বাধার মুখোমুখি হওয়া তার দায়িত্ব—শুধু পিতা ও পরিবারের স্মৃতি রক্ষার জন্য নয়, বরং একটি তরুণ দেশের সেই স্বপ্নগুলোকেও রক্ষা করার জন্য, যা নৃশংস খুনিরা ভেঙে দিয়েছিল। তাঁর মতে, এই ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু মানুষ হত্যা করেনি, তারা একটি জাতির স্বপ্নকেও ধ্বংস করতে চেয়েছিল—একটি উপনিবেশিক ও দমনমূলক শাসনের দীর্ঘ ইতিহাসকে কাটিয়ে উঠতে চাওয়া জাতির।

এই সকল কঠিন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা একটি নীতিকে নিজের পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করেন:

“আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘যদি বাবা শেখ মুজিব বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনি কী করতেন?’ সেই প্রশ্নের উত্তর সবসময় হতো—তিনি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতেন না। তাই আমাকেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শেই অটল থাকতে হবে, যে যুদ্ধের জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছিলেন।”

 

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আদর্শ বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নতুন যাত্রা

দেশবাসীর—বিশেষত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর—প্রয়োজন বুঝতে শেখ হাসিনা দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি বলেন:

“মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন বোঝার জন্য, বিশেষত যারা সমাজে অবহেলিত, তাদের কষ্ট ও স্বপ্নের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করতে হয়। আমি নিয়মিত সাধারণ মানুষদের, বিশেষত গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সাথে দেখা করতে শুরু করি। তাদের মধ্যেই বাংলাদেশের আসল আত্মা নিহিত। আমি অসংখ্য হাটবাজার, গ্রামীণ কেন্দ্র পরিদর্শন করি। সেখান থেকেই আমি সরাসরি জানতে পারি গ্রামের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও তাদের চাহিদা, বিশেষত বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সময়।”

তিনি উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলগুলোও ঘুরে দেখেন—বিশেষ করে রংপুর জেলার সেই অঞ্চল, যেখানে মৌসুমী দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। সেখানকার বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করেন তিনি।

এই অভিজ্ঞতাগুলোতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও পরিকল্পনার প্রতিফলন খুঁজে পান শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু পরিবারে প্রায়ই দেশের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ও বিশদ পরিকল্পনার কথা বলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, উপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব, যদি সুনির্দিষ্ট কৌশল অবলম্বন করা যায়।

শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধে বহু আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ হয়েছেন, আর ১৯৭৫ সালের পর দলটি দিশাহীন হয়ে পড়েছে। তিনি উপলব্ধি করেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে দলকে ঢেলে সাজানো জরুরি।

যদিও অনেকেই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা মানতে চাননি, শেখ হাসিনার বিশ্বাস ছিল—দলকে শক্তিশালী করতে হবে, নিচু স্তর থেকে শুরু করে গোটা কাঠামো পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে তা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।

এই দল পুনর্গঠন ছিল দীর্ঘ ও কঠিন এক প্রক্রিয়া। তবুও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বপ্নই তাঁকে চালিত করেছে। তৃণমূলে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগিয়ে তোলার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, আর সংবিধানে নিহিত মৌলিক আদর্শ রক্ষার দৃঢ় সংকল্প।

 

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বপ্ন: শেখ হাসিনার ব্যাখ্যা

শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন—

“আমার বাবার চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা বোঝার চেষ্টা ছিল আমার জন্য এক অসাধারণ শিক্ষা। তাঁর নীতিগত চারটি স্তম্ভ আমার মনে গেঁথে আছে:
১. স্থিরতা
২. অবহেলিতদের প্রতি সহমর্মিতা
৩. সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর উদ্যোগ
৪. বাস্তবায়নের প্রতি অঙ্গীকার।”

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা—যেখানে প্রতিটি নাগরিক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জীবন যাপন করবে এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই নির্মাণ করতে পারবে। তিনি প্রায়ই বলতেন, প্রতিটি গ্রাম হবে আত্মনির্ভরশীল। এজন্য তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, সড়ক নির্মাণ, নদী খনন, রেলওয়ে সম্প্রসারণ এবং সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা করেছিলেন।

তিনি কল্পনা করেছিলেন এক গ্রামীণ বাংলাদেশের, যেখানে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকবে। ভালোভাবে নির্মিত রাস্তার দু’পাশে থাকবে ধানক্ষেত ও কৃষকের বাড়ি, আর সেই গ্রামের কেন্দ্রে থাকবে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ধর্মীয় উপাসনালয় ও সমৃদ্ধ কমিউনিটি জীবন।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার—ব্যক্তিগত মালিকানা হোক বা সমবায় ভিত্তিক হোক—যাতে উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তিনি কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে ফসলের ভাগ হবে তিনভাগে—জমির মালিক, রাষ্ট্র-সমর্থিত সমবায়, এবং শ্রমিক। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের সুষ্ঠু বিপণন নিয়েও তাঁর সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল।

তাঁর বিশ্বাস ছিল—উদ্ভাবন, সহমর্মিতা ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব। এই বিশ্বাসই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রেরণা ও শিক্ষার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শোক থেকে শক্তিতে: বাংলাদেশের পুনর্জাগরণ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হারানোর শোক শেখ হাসিনার জীবনে এক গভীর অন্ধকার নেমে আনে। নিজেকে ভেঙে পড়া থেকে সামলে নিয়ে সেই ব্যক্তিগত যন্ত্রণা তিনি রূপান্তর করেছেন জনকল্যাণ ও রাষ্ট্রগঠনের শক্তিতে। তিনি লিখেছেন—

“দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য আমি চেষ্টা করেছি ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপান্তর করতে।”

ইতিহাসে বহু ধনী পরিবার শোককে মানবকল্যাণের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছে। যেমন—

  • স্ট্যানফোর্ড পরিবার, যাঁরা একমাত্র সন্তান লিল্যান্ড জুনিয়রের মৃত্যুর পর ১৮৮৪ সালে ৮,০০০ একর জমি দান করে প্রতিষ্ঠা করেন আজকের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

  • উইডনার পরিবার, যাঁরা ১৯১২ সালে টাইটানিক দুর্ঘটনায় পুত্র হ্যারি উইডনারকে হারিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল অনুদান দেন, যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় ও খ্যাতিমান গ্রন্থাগার।

এই উদাহরণগুলো শেখ হাসিনাকে শিখিয়েছে—শোককে কীভাবে মহান উদ্দেশ্যে রূপান্তর করা যায়। তাঁর কাছে ধনসম্পদ না থাকলেও, তিনি উপলব্ধি করেন—অশ্রু, সময় ও সংকল্প বাংলাদেশের সেবায় উৎসর্গ করাই তাঁর শ্রেষ্ঠ দান।

১৯৭৫ সালের সেই অন্ধকার অধ্যায়ের ২১ বছর পর, ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।

২০০৯ সালে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে তিনি উন্নয়নকে আরও বেগবান করেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শনের ধারাবাহিক বাস্তবায়নের ফলেই আজকের বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ডিজিটাল রাষ্ট্রে এবং অর্জন করেছে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ

আজকের বাংলাদেশ বিশ্ব মঞ্চে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর ডিজিটাল রূপান্তর, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, শিল্পোন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্প্রসারণ—সব মিলিয়ে এটি এক পুনর্জাগরিত রাষ্ট্র।

এ অর্জন একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী রাষ্ট্রচিন্তার প্রমাণ, অন্যদিকে তেমনি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার অবিচল, কৌশলী ও নিরলস প্রচেষ্টার ফল।