ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের মাস। এ মাস আমাদের বীর সন্তান-কন্যাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করার মাস, গৌরবের মাস, স্বাধীনতার মাস। পশ্চিম পাকিস্তানের দানবীয় সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে নিছক ইচ্ছাশক্তি, সাহস ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই বিজয় আজও আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক।
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার এই বিজয় মাস প্রতিবছর নানা আনুষ্ঠানিকতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাধ্যমে পালিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ: জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন
বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় বিজয় বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। সেদিন থেকে বাঙালি বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেয়েছে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে।
সবুজ পতাকার বুক জুড়ে লাল সূর্যের উজ্জ্বল প্রতীক ঘোষণা করেছে—এই ভূমি বাঙালির, এই স্বাধীনতা বাঙালির। ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের পূর্ণতা মিলেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও বিজয়ের মধ্য দিয়ে।
ডিসেম্বর: গৌরবের সাথে শোকের মাস
তবে ডিসেম্বর শুধু গৌরবের মাস নয়, এটি শোকেরও মাস। কারণ এই বিজয় এসেছে অসংখ্য জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে। স্বাধীনতা বিরোধীরা পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গড়ে তোলে।
তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান—বুদ্ধিজীবীদের—উপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৪ ডিসেম্বর সারা দেশের বরেণ্য শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, লেখক ও সংস্কৃতিজনদের ধরে নিয়ে হত্যা করে তারা। জাতিকে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করে দেওয়ার এমন ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
মুক্তির যুদ্ধ ও যৌথ বাহিনীর বীরত্ব
একাত্তরের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনী একসাথে আকাশে, জলে ও স্থলে সমন্বিত গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারা একের পর এক পরাজিত হতে থাকে।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনী সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণগুলোর একটি, যেখানে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার ডাক
৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলেছিলেন—
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
তারপর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র মানুষের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়, ঢাকা জ্বলতে থাকে আগুনে। এই রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে শুরু হয় প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। অগ্নিঝরা দিনগুলোতে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর মুক্তিবাহিনী পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়।
দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র গণযুদ্ধের পর, ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়—বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নের স্বাধীনতা।
ডিসেম্বর তাই শুধু একটি মাস নয়—এটি আমাদের অস্তিত্বের শেকড়, আত্মত্যাগের প্রতীক এবং বিজয়ের অমর ইতিহাস। এ মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—স্বাধীনতার মূল্য রক্তে লেখা, আর স্বাধীনতার রক্ষায় সতর্ক থাকতে হবে চিরকাল।
ডিসেম্বরের বিজয় চিরন্তন, বাঙালি জাতির গৌরবের শিখর।
