ধর্ষণ, গণহত্যা ও লুটপাটের পর অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি হানাদাররা

ডিসেম্বর এলেই যেমন বাঙালি জাতি বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে, তেমনি বর্বর পাকিস্তানি সেনারা ডুবে যায় পরাজয়ের গ্লানিতে। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কাছে পরাজিত হওয়ার পরও তাদের বর্বরতা থেমে যায়নি। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে প্রকাশ্যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরও এই জান্তারা সভ্য হতে পারেনি।

ত্রিশ লাখ বাঙালি হত্যা ও অন্তত দুই লাখ নারীকে ধর্ষণের অন্যতম হোতা পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী, রাও ফরমান আলী ও খাদিম হোসেন রাজা তাঁদের আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে অকপটে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

ধর্ষণ, গণহত্যা ও লুটপাটের পর অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি হানাদাররা, Lieutnant General A.A.K. Niazi with his aide-de-camp. (Photo by Christian SIMONPIETRI/Sygma via Getty Images)

 

বন্দি শিবিরেও হানাদারদের হিংস্রতা

মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রায় ৯০ হাজার সেনাসদস্যকে জাতিসংঘের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারত আটক রাখে। কিন্তু বন্দিদশায় থেকেও তারা সমকামিতাসহ নানান অপকর্মে লিপ্ত হয়। এমনকি পরাজয়ের গ্লানি ভুলে দুপুর ও রাতের খাবারের ভাগ নিয়েও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।

শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী বন্দিদশাতেও অন্য অফিসারদের খাবার লুট করে খেতেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো পরাজিত সেনাপ্রধানের এমন নির্লজ্জ ঘটনার নজির বিরল।

২৫ মার্চের গণহত্যার অন্যতম হোতা রাও ফরমান আলী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
“আটক অবস্থায় আমরা সিনিয়রিটি অনুযায়ী টেবিলে বসতাম। নিয়াজী ছিলেন শীর্ষে, আমি ছিলাম ষষ্ঠ। নিয়াজী হাঁড়ির অর্ধেকটাই নিয়ে নিতেন, আমার কাছে আসতে আসতে তাতে এক-দুটি হাড় ছাড়া কিছু অবশিষ্ট থাকত না।”

রাও ফরমান আলী আরও উল্লেখ করেছেন, নিয়াজী শুধু খাবারই লুট করতেন না, নিয়মিত অশ্লীল গল্পগুজবেও মেতে থাকতেন।

 

ধর্ষণ, গণহত্যা ও লুটপাটের পর অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি হানাদাররা, Pakistan Army general Amir Abdullah Khan Niazi (1915-2004) pictured holding a cup of tea as he visits front line troops in the vicinity of Hilli, East Pakistan on 27th November 1971. Pakistan Army troops are currently fighting Bangladesh and Indian Army forces at the Battle of Hilli in the Bangladesh Liberation War. (Photo by Rolls Press/Popperfoto via Getty Images/Getty Images)

 

 

রাজাকার-আলবদর গঠনের স্বীকারোক্তি

জেনারেল নিয়াজী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
“যুদ্ধক্ষেত্র ছিল অপরিচিত। শত্রু কে, মিত্র কে বোঝা কঠিন ছিল। তবে বাঙালিদের ভেতর থেকেই অনেকেই পাকিস্তানিদের প্রতি আনুগত্য দেখায়। তাদের দিয়েই গঠন করা হয় রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিটি এলাকায় পাঠানো হয়। তারা আমাদের অনেক সহায়তা করেছে।”

তবে নিয়াজী স্বীকার করেছেন, যুদ্ধকালে লুটতরাজ, দুর্নীতি ও ধর্ষণের দায়ে কয়েকজন অফিসারকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

লুটতরাজ, দুর্নীতি ও অপরাধ

নিয়াজীর আত্মজীবনীতে উল্লেখ রয়েছে—

  • “লুটতরাজ ও চুরির অভিযোগে ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে কমান্ড থেকে অপসারণ করা হয় এবং পরে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়।” তবে পরবর্তীতে তাকে প্রমোশনও দেওয়া হয়।

  • হাজী মজিদ নামের এক মেজর জেনারেলের বিরুদ্ধেও গুরুতর অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যায়।

  • ১৫ এপ্রিল সেনা সদর দফতরে পাঠানো রিপোর্টে নিয়াজী লিখেছেন:
    “সৈন্যদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য খবর পাচ্ছি। সম্প্রতি ধর্ষণের খবরও বেড়েছে। শোনা যাচ্ছে, প্রত্যাবর্তনকারী পরিবারের মাধ্যমে লুণ্ঠিত মাল পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। এসব জঘন্য কাজে অফিসাররাও জড়িত।”

 

 

সিনিয়র অফিসারদের লুটপাট

নিয়াজী আরও লিখেছেন:
“যুদ্ধের শেষদিকে, যখন পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন বিমানবাহিনীর কিছু পাইলটকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিরাপদে ফেরত পাঠানো হয়। সেই সময়ে জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর ভাগিনার মাধ্যমে স্ত্রীর কাছে লুটের ৮০ হাজার টাকা পাঠান। তাঁর ভাগিনা ছিল হেলিকপ্টার পাইলট। ১৯৭১ সালে এই অঙ্কের মূল্যমান ছিল অনেক।”

নিজের ভূমিকাও তিনি গোপন করেননি। তিনি লিখেছেন:
“১৩ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের নির্দেশ পাওয়ার পর আমি ঢাকার ব্যাংকগুলো থেকে বিদেশি মুদ্রা, নগদ অর্থ ও স্বর্ণ সরিয়ে ফেলি। পরে নোটগুলো জ্বালিয়ে দিই।”

ধর্ষণ, গণহত্যা, লুটপাট এবং পরাজয়ের পরও পাকিস্তানি সেনাদের হিংস্রতা থেমে থাকেনি। আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় তাদের বর্বরতার প্রমাণ আজও ভেসে ওঠে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে তারা শুধু হেরেই যায়নি, নৈতিকতাহীনতার দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছিল, যা আজও মানবসভ্যতার কাছে কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।