বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সাল

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সাল [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman : 1970, February]। এই বছরের শেষে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সে নির্বাচনের পর বিজয়ী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। এর জের ধরে শুরু হওয়া তীব্র রাজনৈতিক সংকট শেষ পর্যন্ত গড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।

 

Table of Contents

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সাল

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 1970, February]

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman : 1970, February]

১৯৭০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ স্মরণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আজকের এইদিনে স্মরণ করি সেইসব শহীদদের যারা নিজের জন্মভূমিকে ভালবাসার অপরাধে অত্যাচারী শাসকের মরণযজ্ঞে অকালে আত্মাহুতি দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman : 1970, February]

আজ স্মরণ করি সেইসব শহীদদের যারা নিজের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে গিয়ে পদলেহণকারী শাসকদের বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন। স্মরণ করি সেইসব ছাত্র ভাইদের গত তেইশ বছর বাঙ্গালীকে মানুষের আসনের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেকে আত্মাহুতি দিয়ে শহীদ হয়েছেন যারা। স্মরণ করি ৭ই জুনের সেইসব শহীদদের যাঁরা ৬ দফার দাবী উচ্চারণ করে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। স্বরণ করি আটষট্টি উণষাটের অবিস্মরণীয় গণবিস্ফোরণের বীর সন্তানদের।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman 1970, February]

 

এই বিজয় বাঙ্গালীর বিজয়

যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, যতদিন এদেশের মাটি থাকবে, যতদিন বাঙ্গালীর সত্বা থাকবে, ততদিন শহীদদের আমরা ভূলতে পারব না। আমরা কোনক্রমেই শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। এই বিজয় সাতকোটি বাঙ্গালীর বিজয়, দরিদ্র জনসাধারণের বিজয়।

ইয়াহিয়া সরকারের মধ্যে এমন একটা দল আছে যারা নির্বাচনের পূর্বে নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছিল, যারা এখনও নির্বাচনের ফলাফল নস্যাৎ করে দিতে চায়। আমি জানি কয়েকদিন আগে ঢাকায় এসে তারা মিটিং করে গেছে। আমি জেনারেল ইয়াহিয়াকে অনুরোধ করি, এই ষড়যন্তকারী দলটিকে সামলান, ঠান্ডা করুণ। ষড়যন্ত্রকারীদের বলি, আপনাদেরও কামান বন্দুকে কাজ হয়নি, হবেও না। আপনাদের বিষদাঁত চিরতরে ভেঙ্গে দেবার জন্য বাংলার জাগ্রত মানুষের লাঠি নিয়েই আপনাদের সঙ্গে লড়াই করবে।

[ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Year 1970, February] ]

চরম সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হোন

ভায়েরা আমার, চরম সংগ্রামের জন্য আপনাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, ষড়যন্ত্রের ফলে গণতন্ত্র যদি ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়, আমি আপনাদের ডাক দেব। সেদিন আপনাদের চরম সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

এই ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে আমি যদি চিরতরে আপনাদের ছেড়ে যাই, আমার মৃত্যুর পর বঞ্চিতা দেশমাতৃকার আর গরীব দুঃখিনী মানুষের মুখের দিকে চেয়ে আপনারা কি পারবেন আন্দোলন করে দাবী আদায় করতে?

দ্রব্য মূল্যের বিরুদ্ধে নিবির কারসাজি আছে। যারা গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চায় তাদের বলি, জিহ্বা সংযত করুণ, নয়ত জিহ্বা কেটে দেব।

আইন করে শিল্পের মালিকানা শ্রমিকদের মধ্যে বণ্ঠন করে দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগকে টাকা দিয়ে বশ করার ক্ষমতা কোন শিল্পপতির নেই!

উত্তর বঙ্গের ভাই বোনেরা শোন, ইনশাল্লাহ যমুনা নদীর পুল হবে, রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষায়ও পুল হবে।

বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে, যে শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের কল্যাণে আসে না তা বাতিল করতে হবে।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ভায়েরা আপনারা শুনে রাখুন, আপনারা পাকিস্তানের সমান নাগরিক। আপনাদের উপর এ যাবৎ ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাচার হয়েছে জানি, আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি আর আপনাদের উপর অত্যাচার হবে না।

[ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Year 1970, February] ]

দূর্ণীতি সহ্য করা হবে না।

সরকারি কর্মচারিদের বলি, আপনাদের খাছিলৎ পরিবর্তন করুণ। মনে রাখবেন, আপনারা যাদের উপর ডান্ডা ঘুরাণ, সেইসব দরিদ্র মানুষের টাকাই আপনাদের সংসার চলে। আপনারা দূর্ণীতি পরিহার করুণ। ইয়াহিয়া ৩০৩ জনকে ছাটাই  করেছেন, আমরা তা করব না। জনসাধারণকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিব-ওই যে দূর্ণীতিবাজ কর্মচারী। তাদেরকেই বলব, সাফ করো এই ঝঞ্জাল।

বড় কে আর বড় হতে দেব না, ছোটকে আর ছোট হতে দেব না। সমাজে ছোট বড় ভেদাভেদ তুলে দিব। ব্যাংক, বীমা কোম্পানী অবশ্যই জাতীকরণ করা হবে।

আওয়ামী লীগের কেউ যদি আপনাদের স্বার্থের সাথে বেঈমানী করে, তবে তাকে জ্যন্ত করব দেবেন।

(দিন তারিখ নিয়ে একটু শংসয় আছে)

[ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, Year 1970, February] ]

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1970, June]

 

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, June]

১৯৭০ সালের ৭ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া ভাষণ

ভাইয়েরা আমার আজ দুটি কথা বলতে চাই। উনি আপনাদের অতি পরিচিত কুমিল্লা জেলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, যুক্তফ্রন্ট করেন। আমাদের শ্রদ্ধেয় মাইন ভাই, সাধারণ সম্পাদক, যে মাইন ভাইকে আপনারা সবাই চিনেন, তার সব বায়েয়াপ্ত করা হয়। জেলখানায় তাকে বন্দী করা হয়। তাকে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগের ইতিহাসের, জনগণের মুক্তির ইতিহাসের সঙ্গে তিনি জড়িত। তিনি মৃত্যুবরণ করলেও তিনি মরে নাই। যতদিন এই দেশের মানুষ থাকবে, তার জীব প্রদীপ নিভে গেলেও এদেশের মানুষ তার দাবী আদায় করতে পারবে।

ভাইয়েরা আমার, পাকিস্তানের ইতিহাস, দুঃখের ইতিহাস। বাইশ বৎসর হয়ে গেল, পাকিস্তানের সরকার এই দেশের দুঃখি মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারে না। বাইশ বৎসর হয়ে গেল…..

(এই আপনারা বসেন, আপনারা বসেন)

ভাইয়েরা আমার, যে কথা বলছিলাম-আজ আপনাদের সামনে বিরাট পরীক্ষা। আপনারা কি করবেন, কি করেছেন, আপনারা ‘স্বাধীন দেশের মতো’ বাস করতে চান কি চান না?

(জনগণ চাই বলে চিৎকার করে)

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, June]

আমি আপনাদের সামনে বলতে চাই। আপনাদের সামনে বিরাট পরীক্ষা। আমরা পুনরায় রক্ত দিয়ে জনগণের ভোটা প্রদান করেছি। আইয়ুব খান এক রক্ত দানব। এই রক্ত দিয়ে জনগণের ভোট আদায় করা হয়েছে। আইয়ুব খান আপনাদের ভোট কেড়ে নিতে চেয়েছিল। আইয়ুব খান গণতন্ত্র কেড়ে নিতে চেয়েছিল। এদেশ তা প্রত্যাখান করেছিল। আপনি কেন তা সাদরে গ্রহণ করলেন, যাতে আপনারা পাকিস্তানে গণতন্ত্র রাষ্ট্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন এবং ভোটাধিকারের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন। এই জন্য গণতন্ত্র চেয়েছিলেন?

ভাইয়েরা আমার আজ ২২ বৎসর স্বাধীনতা পেয়েছি। কি পেয়েছি আমরা? পেয়েছি বিরাগ হাওয়া, পেয়েছি গুলি, পেয়েছি অত্যাচার, পেয়েছি জুলুম, পেয়েছি হুঙ্কার, পেয়েছি দূর্ণীতি, পেয়েছি বুক খা খা করা আর্তনাদ। গরীব যখন কিছু দাবী করে, তাদের উপর গুলি চালিয়ে দেওয়া হয়। শ্রমিক যখন দাবী করে, তাদের অত্যাচার করা হয়। মুজুর যখন দাবী করে, তাদের উপর জুলুম করা হয়। ২২ বছরের ইতিহাস, খুনের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস মীর জাফরের ইতিহাস। ২২ বছরের ইতিহাস, খুবই করুণ ইতিহাস।

ইতিহাস গৃহহারা সর্বহারার আর্তনাদের ইতিহাস, আমরা সংগ্রাম করেছি। ২২ বছর কেটে গেল আমরা জীবন যৌবন ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পেলাম কি আজ আমরা। আজকে দেশের মধ্যে গ্রামে গ্রামে হাহাকার। সব পুড়ে দাউ হচ্ছে। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। আমার দেশের গরীব ভাইয়েরা উদরে ভাত দেয়না, গায়ে কাপড় দেয়না, ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়ে চলছে। আজকে ২২টি পরিবার পাকিস্তানের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়েছে। গরীব দিন দিন গরীব হয়ে গেছে। বড়লোক দিন দিন বড় লোক হয়ে যাচ্ছে।

এই জন্য পাকিস্তানের সাথে সংগ্রাম সংলাপ। আজ এই রেসকোর্স ময়দানের পাশে বাংলাদেশের দুইজন মহান নেতা যারা বাংলার মানুষের জন্য, পাকিস্তানের জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই রেসকোর্স ময়দানের পাশে তারা চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন। শোষক গোষ্ঠি এই বুদ্ধ নেতাদের অনুমান করতে পারেন নাই। ৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পর্যুদস্ত হওয়ার পরে পরিকল্পনা করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে জেলের মধ্যে বন্দি করে, ২০০০ লোককে গ্রেফতার করে।

আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা খুনের আসামী দিয়ে আওয়ামী মুসলীম নেতাদের জেলের মধ্যে বন্দি করে। মৃত্যুকালে সোহরাওয়ার্দী ভিয়েনা হয়ে পাকিস্তানে আসবেন না, সেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে করাচি জেলের মধ্যে বন্দি করে রাখে। জাতীয় নেতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই সোহরাওয়ার্দী শুয়ে আছে রেসকোর্স ময়দানে এই সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যানে।

পাকিস্তানের রাজনীতি হয়েছে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। মরহুম কাদের ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে শহীদ হয়েছে, আজ পর্যন্ত ইনকুযুয়ারি রেজাল্ট বের হয় নাই। যিনি ইনকুয়ারি করতে গেছেন, তাকেও মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। পাকিস্তান খান সাহেবরা লাহোরে হত্যা করলো জাতীয় চার নেতা। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে তারা গরীবদের শোষণ করার জন্য যে উপায়ে উৎপাত করতে শুরু করল। যারে পায় তারে গুলি করে হত্যা করতে শুরু করল। আমারে বন্দী করে জেলের মধ্যে রাখা হল। নানা উপায়ে অত্যাচার অবিচার করা হল।

আমরা এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির উৎখাত চাই। আপনারা শিক্ষা গ্রহণ করেন ইতিহাস থেকে। আজন্মের ফল, কপালের লিখন। তারা সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেছেন। তারপর থেকে শুরু হয়েছে, মিরপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অজ্ঞাত শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য মিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দুনিয়ার (প্রচুর) শ্রমিকদের হত্যা করা হয়েছে। আপনাদের জেল দেওয়া হয়েছে। শোষকদের ধারা আজো শেষ হয় নাই। আমি ষড়যন্ত্রকারীদের সাবধান করে দিতে চাই-আগুন নিয়ে খেলা করোনা, তোমাদের দিন ফুরিয়ে গেছে। ষড়যন্ত্র করে, ইলেকশন বানচাল করে, একনায়কত্ব কায়েম করে গদিতে গমন করার চেষ্টা কর না।

যেমন আইয়ুব খানকে গদিচ্যুত করা হয়েছে, তোমাদের তা মনে রাখা দরকার। তোমরাও মনে রেখো ষড়যন্ত করে দেশ শাসন করা যায় না। গুলি চালিয়ে দেশ শাসন করা যায় না। দেশ শাসন করতে হয়, ভালবাসা মহব্বত দিয়ে। দেশকে ভালবাসতে হয় দশের জন্য কাজ করে। যদি বাড়াবাড়ি কর, যদি আবার ষড়যন্ত্র কর-তাহলে লক্ষ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে এদেশের মানুষের পক্ষ থেকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই-আমি তোমার ফাঁসি কাষ্টে যখন ভয় করি নাই, আমার মা-বোন-ভাইরা যখন গুলি খেতে শিখেছে, আওয়ামী লীগ কর্মীরা যেহেতু গুলি খাইতে পারে, রাজপথের কর্মীরা যখন গুলি খেতে শিখেছে, শ্রমিকরা যেহেতু গুলি খেতে জানে-প্রস্তুত হয়ে যাও, ষড়যন্ত্র যদি করো, এর মধ্যেই করো।

দরকার হয় মৃত্যু বরণ করব। তোমরা চেষ্টা করেছ, আমরা সকলেই জানতে চাই যে, দল নির্বাচিত হয় জনগণের দ্বারা, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এদেশে শাসনতন্ত্র কায়েম করবেন। ব্যক্তিগত কোন লোকের ক্ষমতা নাই পাকিস্তানে গণতন্ত্র দেয়া। যদি কেউ ষড়যন্ত্র করে থাকেন, ভুল করেছেন। ষড়যন্ত্র আর কইরেন না, আর কইরেন না। বাঁধা দিব। দরকার হয় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করব। দরকার হয় শহীদ হবো, কিন্তু পাকিস্তানের গরীব দুঃখী মানুষকে আর শোষণ করতে দেব না।

 

(অসমাপ্ত)

বি,দ্র- ভাষণটি সিডি থেকে শুনে লেখা হয়েছে।

 

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1970, October]

 

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, October]

১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর রেডিও-টিভি ভাষণ

[সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস ও রেডিও পাকিস্তান কর্তৃক আয়োজিত “রাজনৈতিক সম্প্রচার” শীর্ষক বক্তৃতামালায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বক্তা ছিলেন। ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতার ও টিভিতে নিন্মলিখিত ভাষণ দেন। পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্যে বাংলায় ও পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্যে ইংরেজিতে রেকডিং করা হয়। বাংলা ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিম্নরূপ।]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, October]

যে সঙ্কট আজ জাতিকে গ্রাস করতে চলেছে তার প্রথম কারণ, দেশবাসী রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দ্বিতীয়, জনগণের এক বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কবলে পতিত। তৃতীয়, অঞ্চলে অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষ্যমের জন্যে সীমাহীন অবিচারের উপলদ্ধি জন্মেছে। প্রধানতঃ এগুলোই বাঙ্গালীর ক্ষোভ অসন্তোষের কারণ। পশ্চিম পাকিস্তানের অবহেলিত মানুষেরও আজ একই উপলদ্ধি।

আওয়ামী লীগের মেনিফেষ্টোতে এসব মৌলিক সদস্যা সমাধানের একটা সুষ্পষ্ট পথনির্দেশ করা হয়েছে। দেশে প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। সেই গণতন্ত্র মানুষের সকল মৌলিক স্বাধীনতা শাসনতান্ত্রিকভাবে নিশ্চিত করা হবে। আমাদের মেনিফেষ্টোতে রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংস্থা, স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু বিকাশের রূপরেখা নির্দেশ করা হয়েছে। সংবাদপত্র ও শিক্ষার পূর্ণ স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাসী। সমাজে ক্যান্সারের মত যে দূর্ণীতি বিদ্যামান তাকে নির্মূল করতে আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।

বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষণ ও অবিচারের যে অসহনীয় কাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে, অবশ্যই তার আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে। জাতীয় শিল্প সম্পদের শতকরা ৬০ ভাগের অধিক আজ দু’ডজন পরিবার করায়ত্ত্ব করেছে। ব্যাংকিং সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগ এবং বীমা সম্পদের শতকরা ৭৫ ভাগ এ দুই পরিবারের কুক্ষিগত। ব্যাংকের লগ্নীকৃত অর্থের শতকরা ৮২ ভাগ আজ মোট জমাকারীদের মাত্র শতকরা ৩ জনের মধ্যে সীমাবন্ধ। দেমে যে করপ্রথা কায়েম রয়েছে, তা বিশ্বের সবচাইতে পশ্চাদমুখী ব্যবস্থা।

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যখন প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৬ ভাগ আদায় করা হয় সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ২ ভাগ অর্থ আদায় হয়। অপরপক্ষে, লবণের মত অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির উপরেও নিপীড়নমূলক পরোক্ষ কর বসানো হয়েছে। সংরক্ষিত বাজার, ট্যাক্স হলিডে, বোনাস ভাউচারের বিপুল পরিমাণে সাবসিডি প্রদান এবং কৃত্রিমভাবে নিম্নহারে বিদেশী মুদ্রার ঋণ, অর্থ বরাদ্দ প্রভৃতি ব্যবস্থা একচেটিয়াবাদ ও কার্টেল প্রথার সুযোগ করে দিয়েছে।

ছিটেফোঁটা ভূমি সংস্কার সত্ত্বেও সামন্ত প্রভূরা রাজকীয় ঐশ্বর্যের অধিকারী রয়েছেন। তাঁরা সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। তাঁদের সমৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি অসহায় দরিদ্র কৃষকের অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটেছে। কেবলমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে জনসাধারণ দিনের পর দিন গ্রাম ছেড়ে শহরে বলে আসছে। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমশক্তির একপঞ্চমাংশ অর্থাৎ প্রায় ৯০ লক্ষ শ্রমজীবি মানুষ আজ বেকার। জীবনযাত্রার দ্রুত ব্যয়বৃদ্ধির সম্পূর্ণ চাপ এসে পড়েছে শিল্প শ্রমিক মেহনতি সম্প্রদায়ের উপর। মুদ্রা মজুরী যা বাড়ছে তার তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। জীবনযাত্রার সীমাহীন ব্যয় বৃদ্ধির চাপ স্কুল কলেজের শিক্ষক, স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারী, বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণীর সরকারী কর্মচারী আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন।

অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে গত বাইশ বছরে সরকারী রাজস্ব খাতের মোট ব্যয়ের মাত্র পনেরো শত কোটি টাকা মত (মোট ব্যয়ের পঞ্চমাংশ) বাংলাদেশে খরচ করা হয়েছে। অথচ এর পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশের সর্বমোট উন্নয়ন ব্যয় খাতে বাংলাদেশের মোট ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ মাত্র তিন হাজা কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে ছয় হাজার কোটি টাকা।

বিশ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানে তেরো শত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আমদানী করেছে। বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে তিনগুণ বেশি বিদেশী দ্রব্য আমদানী করা হয়েছে। নিজস্ব বিদেশী মুদ্রা আয়ের চাইতেও পশ্চিম পাকিস্তান বাড়তি দু’হাজার কোটি টাকা মুল্যের বিদেশী দ্রব্য আমদানী করতে পেরেছে, তার কারণ বাংলাদেশের অর্জিত পাঁচশ কোটি টাকার বিদেশী মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করেছে। তার উপরেও সর্বপ্রকার বিদেশী সাহায্যের শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবহৃত হয়েছে।

সরকারী চাকরী ক্ষেত্রের পরিসংখ্যানও ঠিক একই রকমের মর্মান্তিক। স্বাধীনতার তেইশ বছর গত হয়েছে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে বাঙ্গালীর সংখ্যা আজও মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ। দেশরক্ষা সার্ভিসে বাঙ্গালীর সংখ্যা মাত্র ১০ ভাগেরও কম। সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ প্রকট বৈষম্যের ফলে বাংলার অর্থনীতি আজ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের মুখে। বাংলার বেশিরভাগ প্রামাঞ্চলের দুর্ভিক্ষজনিত অবস্থা বিরাজ করছে। জনগণকে শুধুমাত্র অনাহারের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যে ১৭ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে।

দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে তার শিকারে পরিণত হয়ে চলেছে বাংলার অসহায় মানুষ। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য শতকরা ৫ থেকে ১০০ ভাগ বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানে যেক্ষেত্রে মোটা চাউলের দাম ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে ঐ একই চাউলের দাম গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। বাংলায় যে আটার দাম প্রতি মন ৩০ ে কে ৩৫ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে তা ১৫ থেকে ২০ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি সের সরিষার তেলের দাম মাত্র আড়াই টাকা, কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি সের তেলের দাম পাঁচ টাকা। করাচীতে যে সোনার দাম প্রতি ভরি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা, ঢাকায় সে সোনার মূল্য প্রতি ভরি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। তারপরেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলার সোনা আনার ব্যাপারে কাষ্টমস এর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

গত বাইশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের অর্থনীতির যে কাঠামো গড়ে তুলেছেন এসব অবিচার তারই পুঞ্জিভূত ফলশ্রুতি। এ অবিচার দূর করার সাধ্য কেন্দ্রীয় সরাকারের নেই। এ সত্যটি প্রমাণিত হয়েছে চতুর্থ পাঁচসালা পলিকল্পনায়। কেন্দ্রীয় সরকার যত বড় শক্তিশালই হোক না কেন অতীতের অন্যায় অবিচার দূরীকরণে সে যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ-চতুর্থ পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দে সে ব্যর্থতার স্বীকৃতি লিপিবদ্ধ রয়েছে।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, October]

 

আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচী, যে, কর্মসূচী ছাত্রসমাজের ১১-দফা কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে সে কর্মসূচী আঞ্চলিক অন্যায়-অবিচারের বাস্তব সমাধানের পথনির্দেশ করেছে। কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রে যেখানে বাংলার প্রতিনিধত্ব মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ এবং দেশে যে ধরনের শাসন ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে তাতে কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কাছ থেকে সুবিচার আশা করা যায় না। বাংলাদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলের রাজনৈতিক  প্রতিনিধিরা বৃহত্তর ব্যয় বরাদ্দ আদায়ের চেষ্টা করলে আঞ্চলিক উত্তেজনাই বৃদ্ধি পাবে এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে ফেডারেল সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।

এ অবস্থায় সমস্যাসমূহের একমাত্র সমাধান হতে পারে শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর পূনবির্ন্যাস করে এবং ফেডারেশনের ইউনিটগুলো আওয়ামী লীগের ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন প্রদান করে। প্রস্তাবিত এ স্বায়ত্বশাসনকে পুরোপুরি কার্যকরী করার জন্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষমতাও অবশ্যই দিতে হবে। এ জন্যেই মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনীতি এবং বিদেশী মুদ্রা অর্জনের উপর ফেডারেশনের ইউনিটগুলির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাদানের ব্যাপারে আমরা সব সময়ই গুরুত্ব দিচ্ছি।

এ কারণে আলাপ-আলোচনার ক্ষমতাও ফেডারেশনের ইউনিট সরকারগুলোর হাতে অর্পণ করা উচিত। এভাবে আমরা কেন্দ্রকে সন্দেহ, সংশয় ও বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগের আঁওতার ঊর্ধ্বে রাখতে চাই। ফেডারেশনের ইউনিটগুলিকে অর্থনৈতিক ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান, ফেডারেশন সরকারকে পররাষ্ট্র বিষয়, দেশরক্ষা বিষয় ও নিরাপত্তামূলক শর্ত সাপেক্ষে মুদ্রা ব্যবস্থার দায়িত্ব দিয়ে একটা ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্যমূলক ফেডারেল সরকার পরিকল্পনা নিখিল পাকিস্তান সার্ভিস বিলোপ সাধন করা হবে এবং ফেডারেল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে!

জনসংখ্যার ভিত্তিতে সকল অঞ্চল থেকে ফেডারেল চাকরিতে লোক নিয়োগ করা হবে। আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, ফেডারেশনের ইউনিটগুলি যদি মিলিমিয়া অথবা প্যারা-মিলিটারি বাহিনী গঠন করে, তবে তারা কার্যকরীভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার সাহায্য করতে সক্ষম হবে। আমাদের প্রস্তাবিত ফেডারেল পরিকল্পনা সংশয় ও বিরোধের অবসান ঘটিয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানের নিশ্চয়তা বিধান করবে। যে অঞ্চলের মানুষ অপর অঞ্চলকে উপনিবেশ বা বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে চান বোধগম্য কারণেই তারা আমাদের এ প্রস্তাবিত পরিকল্পনার বিরোধিতা করবেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের পরিকল্পনা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের পুর্ণ সমর্থন পাবে।

আমাদের বিশ্বাস, শাসনতান্ত্রিক ও কাঠামোর মাধ্যমইে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব এবং অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে বেশবাসীর কঠোর পরিশ্রম ও বিপুল ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশবাসী তখনই সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করবেন যখন ত্যাগ স্বীারের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সকল শ্রেণী সকল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করার আশ্বাস আমরা দিতে পারবো! অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অংশ নিশ্চিত করার জন্যে অর্থনৈতিক কাঠামোতে অবশ্যই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

জাতীয়করণের নামে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানীগুলোসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। অর্থনীতির সবক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সাধিত হবে জনগণের মালিকানায়। নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিকগণ শিল্প ব্যবস্থাপনায় ও মূলধন পর্যায়ে অংশীদার হবেন। বেসরকারি পর্যায়ে এর নিজস্ব ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। একচেটিয়াবাদ ও কার্টেল প্রথা সম্পূর্ণভাবে বিলোপ সাধন করতে হবে। কর ব্যবস্থাকে সত্যিকারের গণমুখী করতে হবে। সৌখিন দ্রব্যাদির ব্যাপারে কড়া নিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।

ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পকে ব্যাপকভাবে উৎসাহ দিতে হবে। কুটিরশিল্পের ক্ষেত্রে কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁতীদের ন্যায্য মূল্যে সূতা ও রং সরবরাহ করতে হবে। তাদের জন্যে অবশ্যই বাজারকরণ ও ঋণ দানের সুবিধা করে দিতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প গড়ে তুলতে হবে। গ্রামে গ্রামে এসব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্পসুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্যে কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

এযাবৎ বাংলার আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ হার এবং পরগাছা ফড়িয়া বেপারীরা পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করেছে। পাটের মান, উৎপাদনের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, পাটের গবেষণার উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে। তুলার প্রতিও একই ধরনের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সেজন্য আমরা মনে করি, তুলা ব্যবসাও জাতীয়করণ করা অত্যাবশ্যক। তুলার মান ও উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে। বিগত সরকারগুলো আমাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল চা, ইক্ষু ও তামাকের উৎপাদনের ব্যাপারেও যথেষ্ট অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। এর ফলে এসব অর্থকরী ফসলের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

একটা স্বল্প-সম্পদের দেশে কৃষি পর্যায়ে অনবরত উৎপাদন হ্রাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না? দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষীদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্যের নিশ্চিয়তা দিতে হবে।

প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জায়গীরদারী, জমিদারী সরদারী প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাস ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে বন্টন করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষীদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি সংহতি সাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকার এজন্যে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

ভূমি রাজস্বের চাপে নির্দিষ্ট কৃষককূলের ঋণভার লাঘবের জন্যে অবিলম্বে আমরা ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ এবং বকেয়া খাজনা মওকুফ করার প্রস্তাব করেছি। আমরা বর্তমান ভূমি রাজস্ব প্রথাও তুলে দেবার কথা ভাবছি।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, October]

 

প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বাধিক উন্নয়নের জন্যে বৈজ্ঞানিক তৎপরতা চালাতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের বন সম্পদ, ফসলের চাষ, গো-সম্পদ, হাঁস-মুরগীর চাষ, দুগ্ধ খামার, সর্বোপরি মৎস্য চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। পানি সম্পদ সম্পর্কে গবেষণা এবং নৌ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্যে অবিলম্বে একটি নৌ-গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক মৌলভিত্তির যে প্রথম তিনটি স্তর সেগুলোকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণকে অবশ্যই প্রথম কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে একটা সুসংহত ও সুষ্ঠু বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা আশু প্রয়োজন।

পশ্চিম পাকিস্তানে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা দ্রুতগতিতে দূরীভূত করতে হবে। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে বিজলী সরবরাহ করতে না পারলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধিত হতে পারে না। একটি সম্প্রসারিত কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে গ্রামে গ্রামে বিজলী সরবরাহ করতে হবে। এর দ্বারা পল্লী অঞ্চলে ক্ষুদ্রায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। পাঁচ বছরে আমরা বাংলাদেশে ২৫০০’ কিলোওয়াটস বিজলী উৎপাদন করতে চাই। রূপপুর আণবিক শক্তি এবং জামালগঞ্জের কয়লা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়িত করতে হবে। প্রাকৃতিক গ্যাস অবিলম্বে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে হবে।

তৃতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ করে উত্তরবঙ্গের সাতে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়টিকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই। সিন্ধু ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে সিন্দু নদের উপর এবং বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা ও কর্ণফুলির উপরেও সেতু নির্মাণ করতে হবে। আভ্যন্তরীণ নৌ ও সামুদ্রিক বন্দরের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সড়ক ও রেল ব্যবস্থার উপরও আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছি।

সু-সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন অক্ষরজ্ঞানহীন। প্রতি বছর ১০ লক্ষেরও অধিক নিরক্ষর লোক বাড়ছে। জাতির অর্ধেকেরও বেমি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শতকরা মাত্র ১৮ জন বালক ও ৬ জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপেক্ষ ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটা ‘ক্র্যাস প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণীর জন্যে খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিক্যাল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয় সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র যাতে উচ্চ শিক্ষার জন্যে মেধাবী ছাত্রদের অভশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ও উর্দু যাতে ইংরেজীর স্থান দখল করতে পারে- সে ব্যাপারে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ ও উন্নয়নের ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে।

নাগরিক জীবনের সমস্যাবলীর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো- নিম্ন আয়ের লোকজন অমানুষিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছেন। তথাকথিত ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টগুলি বিত্তবানদের জন্যে বিলাসবহুল আবাসিক এলাকা নির্মাণে ব্যস্ত। আর এদিকে বাস্তুহারা ও বিত্তহীননের দল এতটুকু আশ্রয়ের সন্ধানে মাথা কুটে ফিরছে। ভবিষ্যত নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র নগরবাসীর সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অল্প খরজে শহরে বাসগৃহ নির্মাণের ব্যবস্থার প্রয়োজন।

চিকিৎসা ক্ষেত্রের এক করুণ পরিবেশ বিদ্যমান। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ সামান্যতম চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। প্রতি ইউনিয়নে একটি করে পল্লী চিকিৎসা কেন্দ্র এবং প্রতি থানা সদরে একটি করে হাসপাতাল অবিলম্বে স্থাপন করা প্রয়োজন। চিকিৎসা গ্রাজুয়েটদের জন্যে ন্যাশনাল সার্ভিস প্রবর্তনের প্রয়োজন। পল্লী এলাকার জন্য ন্যাশনাল সার্ভিস প্রবর্তনের প্রয়োজন। পল্লী এলাকার জন্য বিপুল সংখ্যক মেডিকেল পার্সন্যালদের ট্রেনিং দেওয়া দরকার।

গণআন্দোলনের মতই শিল্প শ্রমিকরা অর্থনীতি ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, যৌথ দর কষাকষি এবং ধর্মঘটের ব্যাপারে তাদের মৌলিক স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের নিজেদের এবং সন্তানদের বেঁচে থাকার মত মজুরী, বাসগৃহ, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার ন্যায্য হিস্যাদানের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে শিল্প উৎপাদন সকল খাতে সর্বোচ্চ পরিমাণ উপাদান বৃদ্ধি করতে হবে।

অর্থনীতির সর্বত্র মজুরীর কাঠামো ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে পুনবিন্যাস করতে হবে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির গ্রাস থেকে নিম্ন বেতনভূক্ত কর্মচারী ও অল্প উপার্জনশীল ব্যক্তিদের বাঁচাবার জন্যে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীলতা আনতে হবে।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, October]

 

সকল নাগরিকের সমান অধিকারে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিশ্চয় জানা আছে যে, আমরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে আসছি। সংখ্যালঘুরাও অন্যান্য নাগরিকদের মতই সমান অধিকার ভোগ করবে। আইনের সমান রক্ষাকবচ সর্বক্ষেত্রেই পাবে। উপজাতীয় এলাকা যাতে অন্যান্য এলাকার সাথে পুরোপুরি সংযোজিত হতে পারে, তারা যাতে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অপর নাগরিকদের মতোই সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, এজন্যে উপজাতীয় এলাকা উন্নয়নের ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপকুলীয় দ্বীপসমূহ এবং উপকূলবতী এলাকায় বসবাসকারীরা যাতে জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে-সেজন্য তাদের সম্পদের সদ্ব্যবহারের  উদ্দেশ্যে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

জাতীয় জীবনের সাথে মোহাজেরদের একাত্ম হয়ে যাওয়া উচিত। এর ফলে স্থানীয় জনগণের সাথে মিলেমিশে সর্বক্ষেত্রে তারা স্থানীয় জনগণের মতই সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

৬ দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচি ইসলামকে বিপন্ন করে তুলেছে বলে যে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে সে মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্যে আমি শেষবারের মত আহ্বান জানাচ্ছি। অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা প্রত্যাশী কোনকিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারেনা।

পররাষ্ট্র নীতির মতো গুররুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- আজ বিশ্ব জুড়ে যে ক্ষমতার লড়াই চলছে সে ক্ষমতার লড়াইয়ে আমরা কোনমতেই জড়িয়ে পড়তে পারি না। এজন্যে আমাদের অবশ্যই সত্যিকারের স্বাধীন এবং জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে।

আমরা ইতিমধ্যেই সিয়াটো, সেন্টো ও অন্যান্য সামরিক জোট থেকে সরে আসার দাবী জানিয়ে এসেছি। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কোনও জোটে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারে আমাদের বিঘোষিত সিদ্ধান্ত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ যে সংগ্রাম চলছে-সে সংগ্রামে আমরা আমাদের সমর্থন জানিয়েছি।

কারোর প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকলের প্রতি বন্ধুত্ব- এ নীতির ভিত্তিতে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে আমরা শান্তি পূর্ণ সহ-অবস্থানে বিশ্বাসী। আমরা মনে করি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে পাকিস্তানে, সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া উচিত, এর মধ্যে আমাদের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ নিহিত রয়েছে। সেজন্য প্রতিবেশীদের মধ্যে বর্তমান বিরোধসমূহের নিস্পত্তির উপর আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করি। জাতিসংঘের প্রস্তাব মোতাবেক কাশ্মীর সমস্যার একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করছি।

দেশবাসী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হলেই এসব কর্মসূচী ও নীতিমালার বাস্তবায়ন সম্ভবপর। আগামী নির্বাচন জাতীয় মৌলিক সমস্যাসমূহ বিশেষ করে ৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে গণভোট রূপে আমরা গ্রহণ করেছি।

রাজনৈতিক কারণে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিকের বিরুদ্ধে ও বিগত গণ অভ্যুত্থানকালীন দায়েরকৃত মামলা, গ্রেফতারী পরোয়ানা ও দন্ডাদেশের প্রত্যাহার করা হলে গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বিনা বিচারে আটক সকল রাজবন্দীকেও মুক্তি দিতে হবে।

জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের গুরুভার বহণ করতে দেয়া কোন প্রকারেই উচিত নয়। রাজনীতিতেও সশস্ত্র বাহিনীর জড়িয়ে পড়া একেবারেই অনুচিত। উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্ত পেশাদার সৈনিকদের জাতীয় সীমানা রক্ষার গুরুদায়িত্ব এককভাবে পালন করা বাঞ্চনীয়।

পরিশেষে আমি বলতে চাই, জাতি হিসেবে আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে আমরা সাফল্যের সাথে তার মোকাবিলা করবোই। প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। যাদের নিয়ে পাকিস্তান গঠিত, তারা শুধুমাত্র একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যেই একত্রে বসবাস করতে পারে।

গণতন্ত্র ধ্বংসের যে কোন উদ্যোগে পরিণতিতে পাকিস্তানকেই ধ্বংস করবে। আমাদের ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ফেডারেশনের ইউনিটসমূহকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন মঞ্জুর করে অঞ্চলে অঞ্চলে সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এ ধরণের ফেডারেল গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় দেশে সামাজিক বিপ্লবের সূচনার জন্যে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আওয়ামী লীগ দেশবাসীর যে সমর্থন ও আস্থার অধিকারী হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি যে, ইনশাল্লাহ, আমরা সাফল্যের সাথে এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, October]

 

১৯৭০ সালের ৩০ অক্টোবর জয়দেবপুরের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আসন্ন ডিসেম্বরের নির্বাচন ক্ষমতা লাভের নির্বাচন নয়। এই নির্বাচনে স্বাধীনতার পর থেকে শোষিত ও অবহেলিত বাংলার ভাগ্য নির্ধারিত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ৬-দফা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে চায়। এর অর্থ এই দাঁড়ায় বাঙ্গালিরাই হবে তাদের নিজেদের সম্পদের মালিক। বাংলার উর্বর মাটিতে যেমন সোনা ফলে, ঠিক তেমনি পরগাছাও জন্মায়। একইভাবে বাংলাদেশে কতগুলো রাজনৈতিক পরগাছা রয়েছে, যারা বাংলার মানুষের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশার জন্যে দায়ী। এসব রাজনৈতিক পরগাছা সামান্য লাভ ও মন্ত্রিত্বের লোভে বাংলার মানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে শোষকদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে।

আসন্ন নির্বাচনে এসব রাজনৈতিক পরগাছাদের শুধু উৎপাটিতই করা হবে না, তাদেরকে চিরতরে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা হবে এই বাংলার মাটি থেকে।

শেরে বাংলা ফজলুল হকের আহ্বানেই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের জয়যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেই হক সাহেবকেই দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অন্যতম সেনানী, তাঁর উপরও নেমে এসেছিল জেল-জুলুম ও অত্যাচারের খড়গ। বাংলার দুর্ভাগ্য ছাড়া এটা আর কি হতে পারে?

কিন্তু আমি সর্তক করে দিয়ে বলতে চাই, আমি শেরে বাংলার মতো তেমন বৃদ্ধ হয়ে পড়িনি। নির্বাচনের পর স্বার্থবাদী মহলে আবার ষড়যন্ত্র চালানোর চেষ্টা করলে তাদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার জন্যে আমি গণআন্দোলনের ডাক দেব। বাংলার মানুষের কল্যাণ এবং মুক্তির জন্যে এটা আমার শেষ সংগ্রাম। গত গণঅভ্যত্থানের সময় জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের ঋণ শোধ করতে প্রয়োজন হলে যাতে আমি জীবনও বিসর্জন দিতে পারি তার জন্যে আপনারা আমাকে দোয়া করবেন।

কারণ বীর শহীদদের সংগ্রামের ফলেই আমরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছি। নির্বাচনের পর জনগণের বিজয়ের বিরুদ্ধে কায়েমি, স্বার্থবাদী মহলের যে কোন ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোর জন্যে প্রয়োজন হলে গণআন্দোলন শুরুর যে পরিকল্পনা আমার রয়েছে তাতে অংশগ্রহণে প্রস্তুত থাকার জন্যে আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি।

২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করার আওয়ামী লীগের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির যারা সমালোচনা করছেন, তাঁদের আমি জানিয়ে দিতে চাই, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এই প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্যে প্রদত্ত কর মওকুফের সুযোগ প্রত্যাহারও আমরা প্রস্তাব করেছি।

কিছু সংখ্যক লোক জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব লোক সমান। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তানী যে কোন নাগরিকের মতোই সমান নাগরিক এবং সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা ভোগের অধিকারী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার জন্যে আমি সংখ্যাগুরু নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানাই। (অংশ বিশেষ)

[সূত্র ঃ দৈনিক পাকিস্তান, ১ নভেম্বর,১৯৭০]

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1970, November ]

 

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, November ]

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech, Year 1970, Month November ]

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, November ]

 

১৯৭০ সালের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধুর বেতারে ভাষণ

পাকিস্তানঅর্জনের দীর্ঘ তেইশ বছর পর আগামী ৭ই ডিসেম্বর এই প্রথম জাতীয় ভিত্তিতে জনগণের সরাসরি ভোটে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। আজ থেকে ২৪ বছর আগে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার রঙ্গীন বুক বেঁধে এমনি করেই একদিন জনগণ ভোট দিয়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে, কিন্তু দিন না যেতেই দেখেছেন পাকিস্তানে জন্মলগ্নে জনগণের দেয়া সুস্পষ্ট ম্যান্ডেটের প্রতি এদেশের এক শ্রেণীর নেতার বিশ্বাসঘাকতার ফলে সব স্বপ্ন তাদের ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছে।

কেবল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষই নয়, সারা দেশের বারো কোটি মানুষই আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নিজ দেশে পরবাসী। পরাধীন আমলেও এ চেহারা এদেশের মানুষের ছিল কিনা তা আপনারাই বিচার করবেন। স্বাধীনতা উত্তর জীবনে বিগত ২৩টি বছর ধরে সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, শোষণ ও বঞ্চনা এদেশের মানুষকে পোহাতে হয়েছে, তার সাক্ষী কেবল আমি বা আমার দলই নয় আপনারাও।

আপনাদেরই সন্তান-ছালাম, বরকত বুকের রক্ত ঢেলে রাজপথে যে সংগ্রামী চেতনায় আমাদের উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছিল, তারই সূত্র ধরে এদেশের আরও শত শত সোনার সন্তানের আত্মদানের পরে হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক রাজনৈতিক কর্মীর অপরিসীম নির্যাতন ভোগের ফলশ্রুতিতে এদেশের মানুষ আজ তাদের অধিকার ফিরে পেতে চলেছে। জনগণের নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের সৃষ্ট ফসল হিসেবে এবারই সর্বপ্রথম দেশের আপামর মানুষের মতামত নিয়ে তাদেরই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশের ভাবী শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিগত দুই যুগের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণেরই মতামত নিয়ে পাকিস্তানের বুকে শোষণহীন, ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠার উপযোগী একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যে সুযোগ আজ এসেছে, তার যথাযথ সদ্ব্যবহার ও নির্ভর প্রয়োগের উপরই এদেশের আপামর জনসাধারণের ভবিষ্যত নির্ভরশীল।

পাকিস্তানের বিগত তেইশ বছরের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারাক্রমে জাতি আজ এক চরম সঙ্কট সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সঙ্কট থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য দেশব্যাপী যে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে তাকে উপলক্ষ্য করে প্রতিপক্ষীয় রাজনীতিকরা সেই পুরাতন প্রতিক্রিয়াশীল শোষক সম্প্রদায়ের প্রভুদেরকেই আবার ক্ষমতার আসনে বসার জন্য উন্মক্ত হয়ে উঠেছেন। একটু তলিয়ে দেখলেই তাদের একারসাজির মাজেজা বুঝা আপনাদের পক্ষেও কঠিন কিছুই নয়।

আপনারাই দেখেছেন। গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শোষণ চক্রের এই বাঙ্গালী দালালরা পাকিস্তানের জন্মাবধি নির্বাচন এড়িয়ে জনগণ থেকে নিজেদেরকে সযত্নে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখে কখনও পশ্চাৎদ্বার দিয়ে, কখনও বা লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে সরাসরি গিয়ে কুচক্রী ও কায়েমী স্বার্থের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণস্বার্থের সমাধির উপর নিজেদের ভাগ্যের ইমারত গড়েছেন, আবার আন্দোলন দেখলেই পিঠটান দিয়ে আরাম কেদারায় শুয়ে নতুন কোন সুযোগের প্রতীক্ষায় দিন গুজরান করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, November ]

 

আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের অপপ্রচারের উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, জনগণকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের, মুরব্বীদের হয়ে গোপন অভিসন্ধি চরিতার্থ করা। কে না জানে যে, এবারকার নির্বাচনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নির্বাচন হওয়ার সাথে সাথে জাতীয় পরিষদের সদস্যরা কিংবা কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার মসনদে গিয়ে বসে পড়বেন, সে সুযোগ সেখানে নেই। ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নই হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সমাপ্ত করার পরই কেবল উঠতে পারে মসনদে বসার প্রশ্ন, তার আগে কখনই নয়।

নির্ধারিত মেয়াদের আগে শাসনতন্ত্র তৈরির কাজ সমাধা করতে না পারলে দেশ বিপর্যয়ের কোন অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে তা ভাবতেও দেশপ্রেমিক মাত্রেরই গা শিউরে উঠার কথা। এতে বিচলিত বোধ করবেন না কেবল তাঁরাই, যাঁরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে দূরে সরিয়ে রেখে অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় বহাল হওয়ার খোয়াব দেখেন অথবা সে কাজে সিদ্ধহস্ত।

আওয়ামী লীগ জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছায় বিশ্বাসী, আর বিশ্বাসী বলেই তাঁদের হয়ে জন্মাবধি তারা সংগ্রাম করে এসেছে। জনগণের অভিরুচি অনুযায়ী দেশ শাসিত হউক, এই কামনাই তাদের সংগ্রামী চেতনার মূল উৎস। তাই পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই জনগণের সুস্পষ্ট ম্যান্ডেটের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে দেশকে যখন বিপদে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্র হয়, তখন তা নস্যাৎ করার জন্য তারা দেশব্যাপী জাতীয় ভিত্তিক সাধারণ নির্বাচন চেয়েছে।

আর জনগণের প্রতি আশ্বাসহীন, দেশ ও দেশের সম্পদ লুট করে ভাগ্য গড়ার নীতিতে বিশ্বাসী আমাদের প্রতিপক্ষীয় এক শ্রেণীর রাজনীতিকরা কায়েমী স্বার্থ, আমলাতন্ত্র ও পশ্চিমাঞ্চলের সামন্তনেতৃত্বে জোতদার, জায়গীরদারদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রচেষ্টাই এ যাবৎ নস্যাৎ করে এসেছেন। আজও সে চেষ্টার বিরাম নেই।

ইতিহাসই স্বাক্ষ্য দেবে, এই বাংলার আপামর মানুষই প্রকৃত প্রস্তাবে পাকিস্তানএনেছিল। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা এই সোনার বাংলাকে শোষণের চারণ ক্ষেত্র পরিণত করার দূরভিসন্ধিতে মেতে নেপথ্যের এক শ্রেণীর কুচক্রীরা যে মতলব এঁটেছিল, এই বাংলার মীর জাফররাই বাব বার সে মতলবের বাস্তবায়নের প্রধান হাতিয়ার হয়ে কাজ করে এসেছে, আর তাই এদেশের তেরো কোটি মানুষের আজ এ দূরাবস্থা।

১৯৫৪ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে কায়েমী স্বার্থ, আমলাতন্ত্র ও পশ্চিমাঞ্চলের সামন্তবাদী নেতৃত্বের চক্র ও চক্রান্তের প্রতিভূস্থানীয় যে মুসলিম লীগকে বাংলার বুক থেকে সমূলে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, কয়েকটি মাস না যেতেই বাংলার কোন সে ছদ্মবেশী “সু-সন্তানরা” সেই মুসলিম লীগ চক্রের সাথেই রাতারাতি হাত মিলিয়ে বাংলার সাত কোটি মানুষের স্বার্থবিরোধী শাসনতন্ত্র রচনার মত্ত হয়েছিলেন, তাও কারও অজানা নয়।

পরবর্তীকালে দেশে জাতীয় ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতিপূর্বে রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা দখলকরে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান যখন বারো কোটি মানুষের শত অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে দেশব্যাপী ‘কবরে শান্তি’ প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হয়েছিলেন, মোনেম খাঁ জাতীয় বাংলার কোন সে মীরজাফর সেই স্বৈরাচারী শাসকের গললগ্ন হয়ে সোনার বাংলাকে অপর অঞ্চলের উপনিবেশ তথা শ্মশানে পরিণত করার চক্রান্ত বাস্তবায়নের পবিত্র দায়িত্ব পালনে সদা সচেষ্ট ছিলেন, যে কাহিনীরও পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন পরে না।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, November ]

 

তাই বলি, বাংলা আর বাঙ্গালির ইতিহাস সিরাজউদ্দৌলা বনাম মীরজাফরের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস বাংলার আপামর মানুষ বনাম জনাব মোনেম খাঁদেরই ইতিহাস। এ ইতিহাস বড় করুন, বড় মর্মন্তÍদ। এই ইতিহাস আবার গৌরবদীপ্তও বটে। বাংলার কচি প্রাণ সালাম বরকতের তপ্ত তাজা রক্তের পিচ্ছিল পথে নুরুল আমীনের আর সার্জেন্ট জহুর মনুমিয়া, আসাদ, শম্ভু, আলাউদ্দিন আর আনোয়ারদের শোক সন্তপ্ত পিতা ভ্রাতা ভগিনীর তথা অশ্রুর রোষানলে মোমেন খাঁনের ক্ষমতার আসনচ্যুতিও এদেশের ইতিহাসের কত গৌরবোজ্জল অধ্যায়।

তবু শিক্ষা তাদের হয়নি। হয়তো বা অতীতে যারা ইসলামের দোহাই দিয়ে এ দেশকে কায়েমী স্বার্থের অবাধ শোষণক্ষেত্রে পরিণত করে রেখেছিলেন আপনি, আমিও সে ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষা নিতে পারিনি। সে শিক্ষা যদি তাদের হত: অথবা দেশবাসী যদি তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম হতেন তাহলে ১৯৬৯ এর প্রচন্ড গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সেদিন যাঁরা নিজ নাম ঠিকানা গোপন করে পালিয়ে বেড়াতে বাঁধ্য হয়েছিলেন, তারা আজ আবার তাদেরই কথিত এদেশের গরু-ছাগল দরবারে ভোটপ্রার্থী হন বা হতে পারে কোন দুঃসাহসে। মানুষের বিচার-বুদ্ধিও প্রতি এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ,এক মহা অগ্নিপরীক্ষা। এ চ্যালেঞ্জের জবাব জনসাধারণ কিভাবে দিবেন, এ অগ্নি-পরীক্ষায় কিভাবেই বা তাঁরা উত্তীর্ণ হতে চান, তা তাঁদেরই বিবেচ্য।

তবে, আমি যা বুঝি, আমার দলীয় সহকর্মীরা যা বুঝেন অথবা এ দেশের সংগ্রামী ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিক সমাজ যা বুঝেন এক কথায় তা হল এই যে, এবারকার সাধারণ নির্বাচনই বাংলার সাড়ে সাত কোটি তথা সারা দেশের তেরো কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের প্রথম ও শেষ সুযোগ। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে কেউ যদি ভেবে থাকেন ভবিষ্যত বংশধরদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধানে তিনি সক্ষম হবেন, তবে ভুল করবেন নিঃসন্দেহে। আর সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হয়তো বা কোনদিনই আর সম্ভব হবে উঠবে না।

জনগণের এতদিনের সংগ্রাম সাধনা, ত্যাগ ও তিতীক্ষার পর দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব ও সুযোগ আবারও যদি সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক নীতি বিরোধী সেই একই পুঁজিবাদী, ধনকুবের, দুর্ণীতিপরায়ণ স্বার্থশিকারী, আমলাতন্ত্র বা একনায়কত্ববাদের হাতে চলে যায় তাহলে দেশ ও দশের সর্বনাশ অবধারিত। আর বয়স্ক ভোটাধিকার ভিত্তিক আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকালে জনগণ ভোটাধিকারটুকুর যথাযথ সদ্ব্যবহার ও নির্ভূল প্রয়োগের মাধ্যমে কুচক্রীদের হাত থেকে সে দায়িত্ব ও সুযোগ যদি ছিনিয়ে আনতে পারেন তবেই দেশ ও দশের কল্যাণ। এই কারণেই আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে।

ভুললে চলবে না যে, পাকিস্তানে এবারই সর্বপ্রথম জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের দ্বারা এ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের মূল সম্পদ শাসনতন্ত্র রচিত হতে চলেছে। বাংলাকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে হলে, এ দেশের বারো কোটি মানুষকে সত্যিকার মুক্তির সন্ধান দিতে হলে চাই মুক্ত কণ্ঠের আওয়াজ-সে আওয়াজ তুলতে হবে বাংলারই জন প্রতিনিধিদের। পশ্চিম পাকিস্তানের অসহায় মানুষের ভোটে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন তাদের অধিকাংশই জীবনে সামন্ত স্বার্থেরই প্রতিভু। তাদের কণ্ঠে কখনও কৃষক শ্রমিক তথা সর্বহারা মানুষের স্বার্থের কথা ধ্বনিত হতে পারে না বরং নিজেদের স্বার্থেই তারা চাইবেন গণ-স্বার্থকে দাবিয়ে রাখতে।

জাতীয় পরিষদে তাদেরকে মোকাবিলা করে এদেশের আপামর মানুষের স্বার্থ ও অধিকার ছিনিয়ে এনে পাকাপাকিভাবে শাসনতন্ত্রে স্থান দেওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে কেবল বাংলার মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ঐক্য। ভিন্ন ভিন্ন দলের পৃথক চিন্তাধারার প্রতিনিধিদের কণ্ঠে বেসুরা আওয়াজ উঠতে বাধ্য। তার উপর রয়েছে বাংলার মীরজাফরদের ভূমিকা। ইতিমধ্যেই অন্যান্য রাজনৈতিক দল কেউ একশত কেউ বা ৩০/৪০টি আসনে দলীয় প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এসব দলের সব কয়টিরই শিকর পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের জন্য তাদের এমনই দরদ যে পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য আপ্রাণ প্রয়াস পেলেও, বাংলাদেশের বেলায় যে কয়টি আসন পাওয়া যায় ভাল-এই নিয়মেই তাঁরা নির্বাচনে নামছেন।

তারা যে বাংলার তথা আপামর জনসাধারণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণে ইচ্ছুক নয়, তার সবচাইতে বড় প্রমাণ তারা নির্বাচনে বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের কোন চেষ্টাই করতে চান না। তারা জানেন, যেন তেন গুটিকয়েক আসন যদি তারা এখান থেকে পার করিয়ে নিতে পারেন তাহলে তাদেরকে বগল দাবা করে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে বাংলাকে সংখ্যালঘু করে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের পথ ঠিকই করে নিতে পারবেন। এ দুরভিসন্ধি সম্পর্কে তাই বাংলার মানুষকে সজাগ থাকতে হবে।

আরেকটি প্রশ্ন হল, নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ অনেক দলই বাংলার জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে চলেছেন। কিন্তু কিভাবে দেশের দু’অঞ্চলের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হবে, কি করে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্রতর প্রদেশগুলির মানুষের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, তার কোন কর্মসূচিই জনসাধারণের সামনে তাঁরা ঘোষণা করেননি। ব্যক্তিগত স্বার্থের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে না। রাজনীতির অঙ্গনে ঢাক ঢাক গুড় গুড় নীতিতেও আমরা বিশ্বাসী নই। তাই, জনগণের জন্য যা চাই তা সুস্পষ্ট ভাষায়, সরাসরি ঘোষণা করি।

এ কারণে, আমাদের বহু নির্যাতনও পোহাতে হয়, কখনও রাষ্ট্রদ্রোহী, কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আবার কখনও বিদেশী চোরের আখ্যাও আমাদের পেতে হয়েছে। তবু জনগণের জন্য যা সত্য ও সুন্দর বলে জেনেছি তা থেকে আমা কখনও বিচ্যুত হয়নি। রক্তচক্ষুর সামনে সত্যকে বর্জন করিনি, রক্তচক্ষু দিয়েই তার জবাব দিয়েছি। দীর্ঘ তেইশ বছর অত্যাচার, নির্যাতন, শাসন-শোষণ আর বঞ্চনার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করে সর্বশেষ কর্মসূচি হিসেবে আমার দল ৬ দফাকে জাতির সামনে পেশ করেছে। এদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজও ৬ দফার সারবত্তা অনুধাবন করে তাদের ১১ দফা কর্মসূচীতে ৬ দফাকে স্থান দিয়ে সংগ্রাম করে চলেছে।

পাকিস্তানের ১৩ কোটি মানুষের সত্যিকার মুক্তিচিন্তার স্বর্ণফসল হিসেবে কাউন্সিল অধিবেশনে ও কর্মীসমাজ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ৬ দফা। এই কর্মসূচীকে আওয়ামী লীগ কারও উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়নি। ৬ দফার গুণাগুণ বিচারের ভার আমরা জনগণের উপরই ছেড়ে দিয়েছি। ৬ দফা বাংলার শ্রমিক কৃষক মজুর মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ ৬ দফা শোষকের হাত হতে শোষিতদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধকার ছিনিয়ে আনার হাতিয়ার, ৬ দফা মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙ্গালী জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর নির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি, ৬ দফা বাঙ্গালির আত্মমর্যাদার সম্মানজনক আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবী, ৬ দফার সংগ্রাম আমাদের জীবন মরণের সংগ্রাম।

তাই এবারকার নির্বাচনে আমার দলের জয়ের অর্থ ৬ দফারই জয় আর ৬ দফার জয়ের অর্থ এদেশের লাঞ্চিত ও বঞ্চিত সাধারণ মানুষের মুক্তি সংগ্রামের জয়।

আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে আমরা ইসলামের বিশ্বাসী নই। একথায় জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য সর্বস্ব ইসলামে আমা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী-ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হযরত রসূলে করীম (সঃ) এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামে সুবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদেরই বিরুদ্ধে।

যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান, সে দেশের ইসলাম বিরোধী আইন পাশের সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন কেবল তাঁরাই যাঁদের ঈমানই আদতে নাজুক আর ইসলামকে যারা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফায়েস্তা করে তোলার কাজে। অতএব আমরা যারা আল্লাহ মজলুম বান্দাদের জন্য সংগ্রাম করছি, তারা ইসলামের বিরোধীতা করাতো দূরের কথা বরং ইসলামের বিধান মতে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠারই উমেদার, আর সে ব্যাপারে প্রতিবন্ধক হলেন তারাই যারা ইসলাম বিপন্নের জিগির তুলে জনগণকে ধোকা দিতে চান।

কথা তোলা হয়েছে যে নির্বাচনী ঐক্যজোটে সম্মত না হয়ে আমরা বাংলার স্বার্থেরই ক্ষতি করছি। বন্ধুগণ বাংলার স্বার্থের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যই আমরা নির্বাচনী ঐক্যজোটে আর বিশ্বাসী নই। অতীতে বহুবার, এমনকি ১৯৫৪ সালে ঐক্যজোট গঠনের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। বাংলার মানুষ গভীর আশায় বুক বেঁধে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করেছিল, কিন্তু আমরা দেখেছি যুক্তফ্রন্টের নাম নিয়েই আওয়ামী লীগ সদস্যরা ছাড়া আর সব অন্য দলের সদস্যরাই কেন্দ্রের সেই ধিকৃত দলটিতে ভিড়ে গিয়েছেন, যে দলকে দুদিন আগে বাংলার আপামর মানুষ বাংলার মাটি থেকে সমূলে উৎখাত করেছে।

ফলতঃ সর্বনাশ হয়েছে বাংলার আর বাঙ্গালির, সর্বনাশ হয়েছে এদেশের তেরো কোটি মানুষের। তাই এবার আর আমরা ভিন্ন চিন্তাদর্শের মানুষের সাথে ঐক্যচোট গঠন করে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাইনে। এবার আমাদের কথা হল কর্মসূচি বলতে কিছু থেকে থাকলে তার ভিত্তিতে জনগণের দরবারে যান, জনগণ আপনাকে গ্রহণ করলে জাতীয় পরিষদে গিয়ে প্রয়োজন হলে আপনার সাথে ঐক্যজোট গঠন করব, এখন নয়।

জাতির এ মহা সন্ধিক্ষণে বাংলার জননায়ক শেরে বাংলা পরলোকে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও আজ আমাদের মাঝে নেই। মানিক ভাই এর ক্ষুরধার লেখনিও আজ চিরতরে স্তব্ধ। প্রাচীন নেতাদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা অতীতের নিয়মে এখনও পশ্চিমাঞ্চলের সেই কায়েমী স্বার্থের কাছে নিজেদের বিকিয়ে রেখেছেন, নয়তো নির্জীব নিস্কর্মা হয়ে বসে পড়েছেন, অন্যের শলা পরামর্শের বশীভূত হয়ে কথা ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। শত প্রতিকূলতা মুখে গর্দাণ খাড়া রেখে কথা বলার মত নেতৃত্বের আজ বড় অভাব।

নিজের সীমাবদ্ধ সামর্থে দেশবাসীর খেদমত করতে গিয়ে অতীতে বহু পরীক্ষার আমাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমার সংগ্রামী জীবনের স্বল্প ও সাধনার আলোকে বিচার করে নিশ্চিতই আজ আমি বুঝতে পারছি ভাগ্যহত বাংলার, এদেশের আপামর তথা সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার বাসনাকে সার্থকরূপ দেওয়ার যে বিরাট গুরু দায়িত্ব আজ আমাদের সামনে, সে দায়িত্ব আজ আমাকেই স্কন্ধে তুলে নিতে হচ্ছে। এদেশের ভাগ্যহত মানুষের ভাগ্য প্রণয়নের দায়িত্ব মাটি হতে অঙ্কুরিত আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে। আমি ও আমার দল সে দায়িত্ব গ্রহণে সম্পূর্ণ প্রস্তুত, কেবল প্রয়োজন জনগণের দোয়া আর শুভেচ্ছা যা কিনা আমাদের এবারের চলার পথে একমাত্র পাথেয়।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, November ]

 

ব্যক্তিগত কৈফিয়ত হিসেবে জনগণের খেদমতে একটিই মাত্র আমার বক্তব্যঃ নিজেদের জীবনের বিনিময়ে যদি এদেশের ভাবি নাগরিকদের জীবনকে কন্টকমুক্ত করে যেতে পারি, আজাদী আন্দোলনের সূচনাতে এদেশের মানুষ মনের পটে যে সুখী সুন্দর জীবনের ছক এঁকেছিল সে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের পথ কিছুটাও যদি প্রশস্ত করে যেতে পারি তা হলেই আমার সংগ্রাম সার্থক মনে করব।

বন্ধুগণ, আমি ক্ষমতার প্রত্যাশি নই। তবু আমার প্রতিপক্ষেরা আমাকে এ অপবাদ দিয়ে চলেছেন। বিগত ২৩ বছর ধরে ক্ষমতার আসন আমি করে কখন আঁকড়ে ধরেছি তার বিবরণ তারা দেন না। বিগত গোল টেবিল বৈঠকের সময়ে আমাকে প্রধান মন্ত্রীদের পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমি তা দু’পায়ে ঠেলে দিয়েছি।

এতে আমার প্রতিপক্ষের বন্ধুদের অনেক কষ্টও হয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত লাভালাভ বা স্বার্থের বখরায় শরীক হয়ে দেশবাসীর স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া আমার রাজনীতির লক্ষ্য কোনদিন ছিল না, আজও নাই। তাই রুষ্ট হলেও প্রধান মন্ত্রীত্বের প্রলোভনের মুখে বাংলা ও বাঙ্গালির স্বার্থের প্রশ্নের নিজ বিবেককে আমি বিকিয়ে দিতে চাইনি। তাঁদের দৃষ্টিতে এ আমার অপরাধ হতে পারে কিন্তু আমার মনে হয় দেশবাসীর দৃষ্টিতে নয়।

বন্ধুগণ, ক্ষমতার প্রত্যাশী আমি নই, তবে শক্তির প্রত্যাশি আমি বটে-কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন অনিচ্ছুক মহলের হাত থেকে দেশবাসীর স্বার্থ ছিনিয়ে আনতে শক্তি আমরা চাই-ই-চাই। সে শক্তি জোগাতে পারেন কেবল জনগণই। এ কারণে জনগণের খেদমতে একটিই মাত্র আমার প্রার্থনা জাতীয় পরিষদে দাঁড়িয়ে বাংলার মানুষের হয়ে এক কণ্ঠে আওয়াজ তুলে বাংলা ও বাঙ্গালীর স্বার্থ ও অধিকার যাতে আমরা আদায় করে আনতে পারি, তার জন্য জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশে ১৬২টি আসনের প্রত্যেকটি আসনে জনগণ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন।

কারণ জনগণের শাসনতন্ত্র চাহিদামত পাশ করিয়ে আনতে হলে অনিচ্ছুক প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় আমরা চাই নির্ভেজাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিজয়ের চাকিকাঠি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি আপনারা আমাকে জাতি, ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে দেন, তাহলে আমি ওয়াদা দিচ্ছি, আপনাদের স্বার্থ ও অধিকার আমি আদায় করে আনবই। আর যদি আপনাদের বিচারে ভুল হয়, আবার যদি পার্লামেন্টে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের দরুন বাংলার প্রতিনিধিরা দলে দলে ভাগ হয়ে বসে বেসুরো আওয়াজ তুলেন, তাহলে হাতে পেলেও সবই আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে, আর তার অর্থ হবে এদেশের বারো কোটি মানুষ ও তাদের ভবিষ্যত বংশধরদের সর্বনাশ। এ সর্বনাশে আপনি আমি জ্ঞানতঃ শরীক হতে পারি কিনা, তা বিচারের ভার আপনাদের উপরই আমি ছেড়ে দিচ্ছি।

বাংলার মীরজাফরদের সম্পর্কে আমি আপনাদের সজাগ করে দিয়ে এই কথাই বলতে চাই যে, তেইশটি বছরের অত্যাচার, অবিচার, শোষণ ও শাসনে বাংলার মানুষ আজ নিঃস্ব, সর্বহারা। ক্ষুধায় তাদের অন্ন নেই, পরনে নেই বস্ত্র, সংস্থান নেই বাস্থানের। বাংলার অতীত আজ সুপ্ত, বর্তমান অনিশ্চিত, ভবিষ্যত অন্ধকার। জাতির এ হেন দুর্দিনে বাংলার ভবিষ্যত সন্তানদের বাঁচাবার দায়িত্ব আপনার। জাতীয় জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পালনের সুযোগ যদি আপনারা আমাকে ও আওয়ামী লীগকে দেন তাহলে এদেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-মধ্যবিত্ত, যারা আজ সর্বস্ব হারিয়ে রিক্ত ও শূন্য হস্ত, তাদের মুখে ইনশাল্লাহ আমরা হাসি ফুটাতে পারব এ বিশ্বাস আমাদের আছে।

বাংলার সকল অধিবাসী সে সংখ্যাশুরুই হইক বা সংখ্যালঘুই হউক সকলকেই আজ দেশাত্ববোধ নিয়ে জেগে উঠতে হবে, মরণপণ করে বাংলার মান ইজ্জত রক্ষার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ঢেলে দিয়ে আজও যারা ঘুমিয়ে আছেন তাদেরকে এবার ডাক দিয় কেবল বলে যেতে চাই, জাগো বাঙ্গালি জাগো। তোমাদের জাগরণেই এদেশের বার কোটি মানুষের মুক্তি।

সামন্ত নেতৃত্ব লাঞ্চিত পশ্চিম পাকিস্তানের আপামর মানুষও আজ তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তোমরা তাদের নিরাশ করো না।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1970, December]

 

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, December]

১৯৭০ সালের ১ ডিসেম্বর নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা। আস্সালামু আলাইকুম। আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন।

আগামী ৭ই ডিসেম্বর সারাদেশব্যাপী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। জনগণের ত্যাগ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ফল হচ্ছে এই নির্বাচন। সারাদেশ ও দেশের মানুষকে তীব্র সংকট ও দুর্গতি থেকে চিরদিনের মতো মুক্ত করার সুযোগ এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1970, December]

দীর্ঘ তেইশ বছরের অবিরাম আন্দোলনের পথ বেয়ে শত শত দেশপ্রেমিকের আত্মদান, শহীদের তাজা রক্ত আর হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক ও রাজনৈতিক কর্মীর অশেষ নির্যাতন ভোগ ও ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণের সামনে আজ এক মহা-সুযোগ উপস্থিত। এই নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নির্বাচিত হবার পরপরই পরিষদ সদস্যরা বা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার গদিতে বসে পড়তে পারবেন না। তাঁদেরকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ সমাধা করতে হবে। বস্তুতঃ স্বাধীনতার তেইশ বছরের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ণের মূল দায়িত্ব এবং অধিকার সর্বপ্রথম এবারই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা লাভ করেছে। তাই এই নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।

আমার দেশবাসী-

আপনাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতীক্ষার পরও যদি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিগণ দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে পাকিস্তান, বিশেষ করে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ চিরতরে দাসত্ব্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। কেননা সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও এক নায়কত্ববাদের প্রতিভূরা দেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ইচ্ছানুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার কাজে পদে পদে বাঁধা দেবে। ভোটাধিকারের নির্ভূল প্রয়োগের মাধ্যমে সেই মহা সুযোগ ও দায়িত্ব যদি আমরা কূচক্রীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারি, তাহলে কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা মানুষের দুঃখমোচন এবং বাংলার মুক্তি সনদ ৬-দফা ও ১১-দফা বাস্তবায়িত করা যাবে। একমাত্র এই কারণেই আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে।

প্রিয় দেশবাসী-

কারাগার থেকে বেড়িয়ে আমরা জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রনিধিত্ব অর্থাৎ এক ব্যক্তি ভোটের দাবী তুলেছিলাম, আর সেটা আদায় হয়েছে। তাই ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা বিশেষ যোগ্যতা ও সুযোগের অধিকারী। এখন বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যরা যদি একই দলের কর্মসূচী ও আদর্শের সমর্থক হন অর্থাৎ সফল প্রশ্নে তারা ঐক্যমতে থাকতে পারেন তবে আমরা অতীতে চাপিয়ে দেয়া সকল অবিচার বৈষম্যমূলক আচরণ, আইন-কানুন এবং বে-ইনসাফি শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারব।

আমাদের ঐক্যবন্ধ প্রচেষ্টা ও সম্মিলিত দাবীর মুখে দেশের অপর অংশের পরিষদ সদস্যগণ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সনদ ৬-দফা ও ১১-দফা মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন। এর কারণ, পরিষদে আমরা সংখ্যাগরিষ্ট থাকব। আর যদি আমরা বিভক্ত হয়ে যাই এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও মতাদর্শের অনৈক্যের দ্বারা প্রভাবাম্বিত হয়ে আত্মঘাতি সংঘাতে মেতে উঠি তাহলে যারা এদেশের মানুষের ভাল চান না ও এখানকার সম্পদের উপর ভাগ বসাতে চান তাদেরই সুবিধে হবে এবং বাংলাদেশে নির্যাতিত নিপীড়িত, ভাগ্যাহত ও দুঃখী মানুষের মুক্তির দিনটি পিছিয়ে যাবে।

আমার ভাই বোনেরা-

শেরে বাংলা আজ পরলোকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নেই। যারা প্রবীনতার দাবী করছেন, তাদের অনেকাংশই হয় ইতোমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর বাঙ্গালী বিদ্ধেষিদের নিকট নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে তল্পিবাহকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন; নয়ত নিঃস্কর্মা, নির্জীব হয়ে পরেছেন এবং অন্যের শলা পরামর্শের বহিভূত হয়ে কথায় ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিৎ বুঝতে পারছি ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরকেই কথা বলতে হবে।

তাদের চাওয়া ও পাওয়ার স্বার্থক ও রূপদানের দায়িত্ব আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে এবং সে কঠিন দায়িত্ব গ্রহণে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তার উপযোগী করেই আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগকে গড়ে তোলা হয়েছে। নিজেদের প্রাণ দিয়েও যদি এদেশের ভবিষৎ নাগরিকদের জীবনকে কণ্ঠকমুক্ত করতে পারি, আগামী দিনগুলোকে সকলের জন্য সুখি, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে পারি এবং দেশবাসীর জন্য যে কল্পনার নক্সা এতদিন ধরে মনের পটে একেছিলাম-সে স্বপ্নের বাস্তব রূপায়নের পথ প্রশস্ত করে দুঃখের বোঝা যদি কিছুটাও লাঘব করে যেতে পারি- তাহলে আমাদের সংগ্রাম স্বার্থক হবে।

আমার প্রিয় দেশবাসী-

আমি ক্ষমতার প্রত্যাশী নই। কারণ, ক্ষমতার চেয়ে জনতার দাবী আদায়ের সংগ্রাম অনেক বড়। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে বক্তব্য পেশ ও দাবী আদায়ের দায়িত্ব যদি আমার উপর ন্যস্ত করতে চান, তাহলে আমাদেরকে শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সে শক্তি হলো পরিষদে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ। কারণ, এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হচ্ছে অধিকার আদায়ের চাবি কাঠি। তাই আমার জীবনের সুদীর্ঘ সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আপনাদের কাছে আমার একটি মাত্র আবেদন-বাংলাদেশের সকল আসনে আওয়ামী লীগের মনোনিত প্রার্থীদেরকে ‘নৌকা’ মার্কায় ভোট দিন।

সংগ্রামী দেশবাসী,

সর্বশেষে আমি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনাদের কাছে কয়েকটি কথা পেশ করতে চাই। আপনারা জানেন ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের যুদ্ধের সময় আমরা বাঙ্গালীরা কিরূপ বিচ্ছিন্ন, অসহায় ও নিরুপায় হয়ে পড়েছিলাম। বিশ্বের সঙ্গে এবং দেশের কেন্দ্রের সঙ্গে প্রায় আমাদের সকল যোগাযোগ ও সম্পর্ক ভেঙ্গে পরেছিল। অবরুদ্ধ দ্বীপের ন্যায় বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষ কেবল মাত্র আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে এক সীমাহীন অনিশ্চয়তার মুখে দিন কাটাচ্ছিল।

তথাকথিত শক্তিশালী কেন্দ্রের প্রশাসনযন্ত্র বিশেষ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সেদিনের সেই জরুরি প্রয়োজনের দিনেও আমাদের নাগালের বাইরে ছিল। তাই আমার নিজের জন্য নয়, বাংলার মানুষের দুঃখের অবসানের জন্য ১৯৬৬ সালে আমি ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম। এই দাবী হচ্ছে আমাদের স্বায়ত্ব শাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের দাবী, অঞ্চলে অঞ্চলে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তার অবসানের দাবী। এই দাবী তুলতে গিয়ে আমি নির্বাচিত হয়েছি।

একটার পর একটা মিথ্যা মামলা জড়িয়ে আমাকে হয়রানি করা হয়েছে। আমার ছেলে, মেয়ে, বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও আপনাদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। আমার সহকর্মীদেরকেও একই অন্যায়- অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। সেই দূর্দিনে পরম করুণাময় আল্লাহর আর্শিবাদ স্বরূপ আপনারাই কেবল আমার সাথে ছিলেন। কোন নেতা নয়, কোন দলপতি নয়, আপনারা-বাঙলার বিপ্লবী ছাত্র, শ্রমিক, যুবক ও সর্বহারা মানুষ রাতের অন্ধকারে কারফিউ ভেঙ্গে মনু মিয়া, আসাদ, মতিয়ুর, রুস্তম, জহুর, জোহা, আনোয়ারার মতো বাংলাদেশের দামাল ছেলে-মেয়েরা প্রাণ দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে মুক্ত করে এনেছিল।

সেদিনের কথা আমি ভুলে যাইনি, জীবনে কোনদিন ভুলব না, ভুলতে পারব না। জীবনে আমি যদি একলাও হয়ে যাই, মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মত আবার যদি মৃত্যুও পরোয়ানা আমার সামনে এসে দাড়ায়, তাহলে আমিও শহীদদের পবিত্র রক্তের সাথে বেঈমানি করবো না। আপনারা যে ভালবাসা আমার প্রতি আজো অক্ষুন্ন রেখেছেন, জীবনে যদি কোনদিন প্রয়োজন না হয়, তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালবাসার ঋণ পরিশোধ করবো।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা

বাংলার যে জননী শিশুকে দুধ দিতে গুলীবিদ্ধ হয়ে তেজগাঁও নাখালপাড়ায় মারা গেল, বাংলায় যে শিক্ষক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ঢলে পড়ল, বাংলার যে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে জীবন দিলো, বাংলার যে ছাত্র স্বাধীকার অর্জনের সংগ্রামে রাজপথে রাইফেলের সামনে বুক পেতে দিল, বাংলার যে সৈনিক কুর্মিটোলার বন্দী শিবিরে অসহায় অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হলো, বাংলার যে কৃষক ধানক্ষেতের আলের পাশে প্রাণ হারালো-তাদের বিদেহী অমর আত্মা বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে, ঘরে-ঘরে গুরে ফিরছে এবং অন্যায় অত্যাচারের প্রতিকার দাবী করছে।

রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে যে আন্দোলন তারা গড়ে তুলেছিলেন, সে আন্দোলন ৬-দফা ও ১১-দফার। আমি তাদেরই ভাই। আমি জানি, ৬-দফা ও ১১-দফা বাস্তবায়নের পরই তাদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। কাজেই আপনারা আওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রার্থীকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি আসনে জয়যুক্ত করে আনুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জালেমদের ক্ষুরধার নখদন্ত জননী বঙ্গ ভূমির বক্ষ বিদীর্ণ করে তার হাজারো সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জয়যুক্ত হবো।

শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে পারেনা। অন্যায় সত্যের সংগ্রামে নিশ্চই আল্লাহ আমাদের সহায় হবে।

জয় বাংলা

সংগ্রহ-সিডি শুনে রচিত

 

১৯৭০ সালের ৬ ডিসেম্বর নির্বাচনের পূর্বে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সর্বপ্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হয় ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ সালে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশের উভয় অঞ্চলের মধ্যে আসন বন্টন করা হয়। মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯০টি আসনের নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের একটি আসনের একজন  প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দিতার নির্বাচিত হন। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানের ৯টি আসনের নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়। ২৫টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীসহ মোট ১,৫৫৫ জন প্রার্থী ২৯০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ২টি কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭০ আওয়ামী লীগ প্রধান দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নিম্নোদ্ধৃত বাণী প্রদান করেন।]

উদ্দেশ্যে এবারই সর্বপ্রথম জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের দ্বারা এ দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের মূল সনদ শাসনতন্ত্র রচিত হতে চলেছে। বাংলাকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে হলে, এ দেশের ১৩ কোটি মানুষকে সত্যিকার মুক্তির সন্ধান দিতে হলে চাই এক কণ্ঠের আওয়াজ, সে আওয়াজ তুলতে হবে বাংলারই জনপ্রতিনিধিদের, পশ্চিম পাকিস্তানের অসহায় মানুষের ভোটে যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁদের অধিকাংশই এ দেশের সামস্ত স্বার্থেরই প্রতিভূ। তাঁদের কণ্ঠে কখনো দেশের কৃষক-শ্রমিক তথা সর্বহারা মানুষের স্বার্থের কথা ধ্বনিত হতে পারে না। বরং নিজেদের স্বার্থই তাঁরা চাইবেন। গণস্বার্থকে দাবিয়ে রাখতে।

জাতীয় পরিষদে তাঁদের মোকাবিলা করে এ দেশের আপামর মানুষের স্বার্থ ও অধিকার ছিনিয়ে এনে পাকাপাকিভাবে শাসনতন্ত্রে স্থান দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে কেবল বাংলার মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ঐক্য। ভিন্ন ভিন্ন দলের পৃথক চিন্তাধারার প্রতিনিধিদের কণ্ঠে বেসুরো আওয়াজ উঠতে বাধ্য। তার উপর রয়েছে বাংলার মীরজাফরদের ভূমিকা। ইতিমধ্যেই আপনারা দেখেছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দল কেউ ৯০/৯৫টি, কেউবা ৩০/৪০টি আসনে দলীয় প্রার্থী দাঁড় করিয়াছেন।

একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, এসব দলের সব কয়টিরই শিকড় পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের জন্যে তাদের এমনই দরদ যে, পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্যে প্রয়াস পেলেও, বাংলাদেশের বেলায় যে কয়টি আসন পাওয়া যায়, ভাল-এই নিয়মেই তাঁরা নির্বাচনে নেমেছেন। তাঁরা যে বাংলার তথা আপামর জনসাধারণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণে ইচ্ছুক নয়, তার সবচাইতে বড় প্রমাণ তাঁরা নির্বাচনে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের কোন চেষ্টাই করতে চান না। তাঁরা জানেন যেনতেন প্রকারে গুটিকয়েক আসনে যদি তাঁরা এখান থেকে তাঁদের প্রার্থীকে পার করিয়ে নিতে পারেন, তাহলে তাঁদেরকে বগলদাবা করে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে বাংলাকে সংখ্যালঘু করে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের পথ ঠিকই করে নিতে পারবেন। এ দুরভিসন্ধি সম্পর্কে তাই বাংলার মানুষকে সজাগ থাকতে হবে।

ক্ষমতার প্রত্যাশী আমি নই। তবে শক্তির প্রত্যাশী আমি বটে-কায়েমি স্বার্থসম্পন্ন অনিচ্ছুক মহলের হাত থেকে দেশবাসীর স্বার্থ ও অধিকার ছিনিয়ে আনতে শক্তি আমার চাই-ই চাই। সে শক্তি যোগাতে পারেন কেবল আপনারাই। এ কারণে, আমাদের খেদমতে একটাই মাত্র প্রার্থনা জাতীয় পরিষদে দাঁড়িয়ে বাংলার মানুষের হয়ে এক কণ্ঠে আওয়াজ তুলে বাংলা ও বাঙ্গালির স্বার্থ ও অধিকার যাতে আমরা আদায় করে নিতে পারি তার জন্যে জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের ১৬২টি আসনে প্রত্যেকটি আসনে আপনারা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন।

কারণ, আপনাদের চাহিদামতো শাসনতন্ত্র পাস করিয়ে আনতে হলে অনিচ্ছুক প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় আমরা চাই নির্ভেজাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি আপনারা আমাকে জাতি, ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে দেন, তাহলে ওয়াদা দিচ্ছি, আপনাদের স্বার্থ ও অধিকার আমি আদায় করে আনবই। আর যদি আপনাদের বিচার ভুল হয়, আবার যদি পার্লামেন্টে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের দরুন বাংলার প্রতিনিধিরা দলে দলে ভাগ হয়ে বসে বাইরে চলে যাবে। আর তার অর্থ হবে এ দেশের ১৩ কোট মানুষ ও তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সর্বনাশ। এ সর্বনাশে আমি আপনি জ্ঞানত শরিক হতে পারি কিনা তা বিচারের ভার আপনাদের উপরই আমি ছেড়ে দিচ্ছি।

[সূত্র ঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০]

 

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর ৯ ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে ১৫৩টি আসনের মধ্যে ১৫১টি আসন লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার ২টি আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়ী হন। প্রাদেশিক কাউন্সিল লীগ প্রধান খাজা খায়ের উদ্দিন ১ লাখের বেশি ভোটে বঙ্গবন্ধুর কাছে পরাজয় বরণ করেন। এ নির্বাচনে অন্যান্য পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, কাজী আব্দুল কাদের, মাহমুদুল হক ওসমানী, অধ্যাপক গোলাম আজম, ফরিদ আহমদ, ওয়াহিদুজ্জামান, আব্দুর রহিম, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, এয়ার মার্শাল আসগর খান।

জাতীয় পরিষদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরাট সাফল্য ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ অফিসে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদেও স্বাগত জানান এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসাবে তার বিবৃতির প্রদান করেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে স্বাগত জানান এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসাবে তার বিবৃতির শেষে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেন। বিবৃতির বঙ্গানুবাদ দেওয়া হলো।]

আমাদের জনসাধারণ একটি ঐতিহাসি রায় প্রদান করেন। একটি দূর্দমনীয় সংগ্রাম পরিচালনা করে তারা এই রায় প্রদান করার অধিকার নিজেদের জন্যে অর্জন করেছেন। এই সংগ্রাম পরিচালনার সময় হাজার হাজার মানুষ জীবন বিসর্জন দিয়েছেন এবং অগণিত লোক বছরের পর বছর ধরে উৎপীড়ন ও নির্যাতন ভোগ করেছেন। জনসাধারণের সংগ্রামের এই প্রথম মহান বিজয়ের জন্যে আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।

আমরা আমাদের শহীদানের স্মৃতির প্রতি সালাম জানাই। আমরা আমাদের জনসাধারণ, বীর ছাত্র সমাজ, মজুর ও কৃষকদের অভিনন্দন জানাই। আমরা যাতে একদিন প্রকৃত স্বাধীনতায় বসবাস করতে পারি তার জন্যে এরা বর্বরোচিত নির্যাতনের মুখেও অকুতোভয় সংগ্রাম করেছেন। আওয়ামী লীগের এই বিজয় প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের লাখো লাখো নির্যাতিত মানুষেরই বিজয়। আমাদের দেশের জনসাধারণের অর্থাৎ আমাদের ছাত্র, আমাদের মজুর এবং আমাদের কৃষক প্রাণঢালা ভালোবাসায় আমরা অভিভূত হয়ে পড়েছি।

এরা পরিস্কারভাবে প্রমাণ করেছেন যে, আওয়ামী লীগ হলো তাদের দল। আমরা এ বিষয়ে সুনিশ্চিত যে, তারা এই সত্যটি আগামী ১৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক নির্বাচনেও প্রমাণ করবেন। আমাদের দলীয় কর্মীরা নিরতিশয় বাধা-বিপত্তি সত্ত্বে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ চালিয়ে গেছেন। তারা আজ যথোচিতভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন বলে মনে করার কারণ রয়েছে। জনসাধারণের মধ্যে বিরাট একতা ও ব্যাপক গণজাগরণই ছিলো আমাদের কর্মীদের পুরস্কার। জনসাধারণ প্রত্যেকটি ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে এবং শৃঙ্খলার সাথে সাধারণ নির্বাচনে একটি পরিস্কার রায় প্রদান করেছেন। এই নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের জন্যে গণভোটের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ রায় প্রদান।

যে যাই হোন না কেন, আমাদের লক্ষ্য সামনে রয়েছে এবং এই লক্ষ্যগুলো অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। ৬-দফার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে একে সর্বতোভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশ এবং এর অগণিত জনসাধারণকে প্রকৃতির ধ্বংসলীলা ও কায়েমী স্বার্থ থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। অন্যান্য বহুবিধ সমস্যা ছাড়াও ক্ষুধা, বেকারত্ব, রোগশোক, বন্যা-দূর্ভিক্ষ এবং নিরক্ষরতা প্রভৃতি সমস্যার সমাধান অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ লোক মারা গেছে এবং বর্তমানে এ অঞ্চলগুলোতে ৩০ লাখ লোক শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের জনসাধারণের এই অবস্থা আমাদের অতীতের শোষণ ও অবহেলার নিষ্ঠুরতাকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আর সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের পাহাড় প্রমাণ কর্তব্যকে।

আমরা মনে করি, কায়েমি স্বার্থবাদীদে শোষণ ও প্রকৃতির অভিশাপ থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্যে আমাদের সব শক্তি ও সহায়সম্বল নিয়োজিত করার পবিত্র ওয়াদা করাই হলো জনসাধারণের এই বিজয় উদযাপনের একমাত্র উত্তম পন্থা। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে আমরা শোষণমুক্ত একটি নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করছি।

পশ্চিম পাকিস্তানের গণজাগরণের ঢেউ জেগেছে। আমাদের গণজাগরণের এই প্রথম লক্ষণকে স্বাগত জানাই। জনতাকে তাদের বাঙ্গালি ভাইদের বহুদিনের আশা-আকাঙ্খাকে আদায়ের জন্যে আমাদের সমর্থন করার উদ্দেশ্য আহ্বান জানাই। পক্ষান্তরে আমরাও আমাদের পক্ষ থেকে সামন্ততন্ত্র ও অন্যান্য কায়েমি স্বার্থবাদীদের নির্যাতন থেকে তাদের মুক্তি সংগ্রামে আমাদের সমর্থনের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।

আমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা আজ যে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি, তা আমরা আমাদের জনগণের ব্যাপক সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে মোকাবিলা করতে পারব। আমাদের জনসাধারণ আজ ভবিষৎ বংশধরদের সম্পর্কে তাদের দায়িত্বাবলী বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছে, এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই আমরা শক্তি ও আশা লাভ করি। গণঐক্যের দৃঢ় ভিত্তির উপরই একমাত্র আমাদের সমাজের পুনঃর্গঠন এবং অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষের মধ্যে অবিচার দূর কার কার্যকরী কর্মসূচীতে রচিত হতে পারে। তাই আমরা আমাদের লাখ লাখ নির্যাতিত মানুষের দুর্গতি লাঘবে, স্বাধীনতা এবং সমৃদ্ধির জন্যে অতীতের সমস্ত তিক্ততা, বিভেদ এবং শত্রুতা ভুলে যেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।

জয় বাংলা

সূত্র ঃ পূর্বদেশ, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭০

 

১৯৭০ সালের ১১ ডিসেম্বর সন্দ্বিপ হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেন

[জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয়বারের মতো ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত অঞ্চল পরিদর্শনের জন্যে ১০ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। সপ্তাহব্যাপী এ সফরে বঙ্গবন্ধু নৌকা ও পায়ে হেঁটে বিঃধ্বস্ত এলাকার অনেক অংশ সফর করেন, প্রতিদিন অসংখ্য সভায় বক্তৃতা করেন। দলীয় ত্রাণতৎপরতা তদারক করেন। ১১ ডিসেম্বর সন্দ্বীপ হাই স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রদত্ত তাঁর ভাষণের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]

আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে আপনাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। এটা আমার জয় নয়, এটা ৭ কোটি বাঙ্গালীর জয়। আমার কথা মতো কাজ করায় এবং সর্বদা আমাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানানোর জন্যে আমি জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

আমি পুনরায় জনগণের প্রতি আশ্বাস দিচ্ছি, ৬-দফার উপর ভিত্তি করেই দেশর শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে। আওয়ামী লীগ এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং ইন্শাআল্লাহ আমরা এমন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবো যার ফলে বাঙ্গালীদের শোষণের যগের অবসান হবে। যদি নির্বাচনে জনগণ অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিতো তাহলে তাদের কুকুর-বিড়ালের মতো মরতে হতো। এখন কেমন করে বাংলার দাবি ঠেকিয়ে রাখা হয় সেটা আমি দেখবো।

আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্যে আপনারা রক্ত দিয়েছেন এবং প্রয়োজন হলে সে ঋণ শোধ করার জন্যে আমিও রক্ত দান করবো।

আমি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে অব্যস্ত নই। যদি আমি একবার কোন প্রতিজ্ঞা করি তাহলে সে প্রতিজ্ঞায় অটল থাকি। আর আমার এক প্রতিজ্ঞা রক্ষার দিন নিকটতর হয়েছে। শিগগিরই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেয়া হবে।

আমি অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র এলাকায় বাঁধ দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। এজন্যে টাকা নেই এ কথা আমি আর শুনতে রাজি নই।

ঘূর্ণিঝড়-পীড়িত জনগণকে সাহায্যের ভিত্তিতে রিলিফ দিতে হবে। তাদের ঋণ দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, সব সাহায্যই বিদেশী রাষ্ট্রগুলো দিয়েছেন। সুতরাং টাকা পয়সা, হালের বলদ, বীজ, গৃহনির্মাণের সাজ-সরঞ্জাম এবং সবকিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যই তাদেও বিনামূল্যে দিতে হবে।

অন্যান্য দূর্গত অঞ্চল সফরকালে আমি দেখতে পেয়েছি, দূর্গত জনগণের কাছে যথাযথ ও প্রচুর সাহায্য-সামগ্রী পৌঁচাচ্ছে না। আমি সর্তক করে দিচ্ছি যে, এ ব্যাপারে কোন দায়িত্বহীনতা সহ্য করা হবে না, রিলিফ অর্থের কোনরকম অনিয়ম করতে দেয়া হবে না। রিলিফ কর্মকান্ডের সকল সংশ্লিষ্টকে স্মরণ রাখা উচিত যে আইয়ুব খানের দিন শেষ গেছে আমরা প্রতিটি পয়সার হিসাব নেব।

[সূত্রঃ দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক আজাদ, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭০]

১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান কতৃক ইয়াহিয়া খানকে প্রেরনকৃত তারবার্তা

[১১ ডিসেম্বর, ১৯৭০ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে নির্বাচনে তাঁর দলের সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠান। নির্বাচনী সাফল্যে ভুট্টোও বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান। বঙ্গবন্ধু জবাবে ভুট্টোকেও অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান যে তারবার্তা প্রেরণ করেন তা নিম্নরূপ।]

চট্টগ্রাম ও ঘূর্ণি উপদ্রুত সন্দ্বীপ সফর শেষে ঢাকা ফিরে আমি আপনার অভিনন্দন বাণী পেয়েছি। এজন্যে ধন্যবাদ। বাংলাদেশের মানুষ অভূতপূর্ব একতা প্রদর্শন করে আমাদের ৬-দফা শাসনতান্ত্রিক ফর্মূলার স্বপক্ষে দ্ব্যর্থহীন রায় ঘোষণা করেছে। একমাত্র ৬-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে প্রণীত শাসনতন্ত্রই অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের ইচ্ছা অনুসারে শাসনতন্ত্র রচনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন, মহান আল্লাহর কাছে এটাই আমার প্রার্থনা।

[সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০]

 

১৯৭০ সালের ১৯ ডিসেম্বর সংবাদপত্রের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রদানকৃত বিবৃতি

[১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০ তারিখে ৩১০ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তানপরিষদের ২৭৯টি আসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৬৮ টি আসন লাভ করে। পিডিপি পায় ২টি, ওয়ালী ন্যাপ, জামাত ও নেজামে ইসলাম ১টি করে ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬টি আসন লাভ করে। সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনও আওয়ামী লীগের সুনিশ্চিত। উল্লেখ্য, পূর্ব পাকিস্তানথেকে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের কোথাও ৩ মুসলিম লীগের কোন প্রার্থী জয়লাভ করেনি। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষিত হবার পর ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্যে এই বিবৃতি প্রদান করেন।]

জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন বিজয়ে আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ এবং আমার প্রিয় দেশাবাসী-ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকদের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতায় অভিভূত হয়ে পড়েছিল। আমাদের ৬-দফা কর্মসূচীর পক্ষে এক ঐতিহাসিক রায় প্রদানের জন্য আমি জনসাধারণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা এই রায় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতেছি। ৬-দফা কর্মসূচী ভিত্তিক ছাড়া কোন শাসনতন্ত্র হতে পারে না।

আমি চাল, খাওয়ার তেল ও অন্যান্য নিত্যব্যহার্য দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান মূল্যের ব্যাপারটি গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি। মনে হচ্ছে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর বিঘ্নিত করার জন্য কায়েমি স্বার্থবাদীদের কোন চেষ্টারই একটি অংশ। তাদেরকে হুশিয়ার করে দিতে চাই যে, ঐ ধরণের অপরাধমূলক কাজের জন্য যারা দায়ী জনসাধারণ তাদেরকে ক্ষমা করবে না। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই ধরনের শোষণ চলে অবশ্যই এমন একটি ব্যবস্থার দ্বারা এর অবসান ঘটাতে হবে যা আমাদের মেহনতী জনগণের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম।

বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক শস্যহানির দরুন আমরা যে দূর্ভিক্ষের হুমকির সম্মুখীন, এতে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য ও মওজুত ও বিতরণের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এই ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জনগণকে জানানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

আমি আহ্বান জানাচ্ছি, বাংলাদেশের ঘুর্ণি-উপদ্রুত এলাকার রক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের রিলিফের জন্য যে বৈদেশিক মুদ্রা ও অন্যান্য সাহায্য এসেছে, তার সমুদয় প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনয়ন করা উচিত। রিলিফ হিসাবে প্রাপ্ত এই ধরনের অর্থের বোনাস রেটের সুবিধা দেয়া উচিত। প্রাপ্ত সমুদয় বৈদেশিক মুদ্রা অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের ঘূর্ণি-উপদ্রুত এলাকাসমূহে ব্যয় করতে হবে। যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের আমলাদের দ্বারা রিলিফ কাজে সৃষ্টি বিঘ্ন সমূহ এখনো বিদ্যমান থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেহেতু এ যাবৎ প্রাপ্ত সমুদয় বৈদেশিক মুদ্রা ও অন্যান্য সম্পদ এবং এ যাবৎ এর কি পরিমাণ ব্যবহার হয়েছে, সে ব্যাপারে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ হোক। এই ব্যাপারে যে মারাত্মক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে এই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদানের জন্য আমি প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানাই।

প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক তৎপরতা সংক্রান্ত অপরাধে দন্ডিতদের ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। আমরা এর প্রশংসা করি। আমরা সবসময় এ ধরনের ক্ষমা প্রদর্শন এবং রাজনৈতিক তৎপরতা সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় দন্ডিতসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, এই ক্ষমা পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হোক এবং রাজনৈতিক তৎপরতা সংক্রান্ত অপরাধের ব্যাপারে কারাগারে আটক ছাত্র শ্রমিকসহ সকল রাজবন্দীর অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হোক। রাজনৈতিক তৎপরতা সংক্রান্ত সকল মামলা এবং বিনা বিচারে আটক সকল রাজবন্দীরও মুক্তি দেয়া উচিত।

অন্যান্য মারাত্মক সমস্যাবলির মধ্যে ক্ষুধা, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা ও বন্যা আমাদের সামনে রয়েছে। যাতে আমরা একটি উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি, তজ্জন্য আমরা আমাদের জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে সম্ভব সবকিছু করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

[সূত্রঃ সংবাদ, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭০]

১৯৭০ সালের ২৫ ডিসেম্বর পাবনার জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[২৫ ডিসেম্বর ১৯৭০ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দিন ও ডঃ কামাল হোসেনকে সাথে নিয়ে পাবনা রওয়ানা হন। বিকেলে পাবনার পুলিশ ময়দানে আহমদ রফিকের স্বরণে প্রায় লক্ষ লোকের এক শোকসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। পথে পাবনা পৌঁছে তিনি মরহুমের মাজারে ফাতেহা পাঠ করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গকে সাত্ত্বনা দিতে আহমদ রফিকের বাসভবনে যান। শোকসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]

বাংলাদেশের শহীদদের তালিকায় আরো ২টি নাম অন্তর্ভূক্ত হল। তাঁরা হচ্ছেন আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত পাবনার আহমদ রফিক ও খুলনার মমতাজ উদ্দিন। তবে তথাকথিত বিপ্লবীদের রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের মত মারাত্মক উস্কানিমূলক কর্মতৎপরতা সত্ত্বের পূর্ণ শান্তি বজায় রাখার জন্যে আপনাদেরকে আমি অনুরোধ করছি। আমার দল যীশুর নীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমি একজন মুসলমান এবং আমি জানি কি করতে হয়। ঢিলটি মারলে যে পাটকেলটি খেতে হয়, আমি সে নীতিতে বিশ্বাসী। তবে আমি বলব তার আগে জনগণের উচিত সরকার এই ব্যাপারে কি করে, তার জন্যে অপেক্ষা করা। অবিলম্বে নবনির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য আহমদ রফিক ও খুলনার মমতাজউদ্দিনের হত্যাকান্ডের জন্যে দায়ী ব্যক্তিদের সরকার শান্তি দিতে না পারলে বাংলার মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে এবং তার মারাত্মক পরিণতির জন্যে সরকার দায়ী থাকবেন।

এই ধরনে জঘন্য কার্যক্রমে জড়িত একটি বিশেষ দল সবসময়ই জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। এসব রাজনৈতিক হত্যাকান্ড বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক বিরাট ষড়যন্ত্রেরই অংশবিশেষ। প্রতিক্রিয়াশীল ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের বিরুদ্ধে জনগণের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর সেই ষড়যন্ত্রের জাল আবার নতুন করে বিস্তার শুরু করেছে। আপনারা ৬-দফা ও ১১-দফার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। আপনারা আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের সকল রকমের বাধাবিপত্তি অতিক্রমের শক্তি যেন আমি পাই। আওয়ামী লীগ কিংবা ৬-দফা ও ১১-দফার দাবিতে ভোটদানকারী বাংলার মানুষ, কেউ দুর্বল নয়। আগামী ৩রা জানুয়ারি রমনা রেসকোর্সে আওয়ামী লীগ যে জনসভার আয়োজন করেছে, সেখানে আমি আমার পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবো।

আহমদ রফিককে মনোনয়নের আগেও দুস্কৃতকারীরা তাঁকে ৩ বার ছুরি দিয়ে আঘাত করে, কিন্তু তিনি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। এ ধরনের কার্যকলাপ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, নয়তো গুন্ডাদের জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শহীদদের স্বপ্ন অবশ্যই বাস্তবায়িত করা হবে। সবাইকে আমি নিহতদের আত্মার জন্যে দোয়া করতে বলছি।

[সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭০]

 

১৯৭০ সালের ২৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর পত্রিকায় দেয়া বিবৃতি

[২২ ডিসেম্বর ১৯৭০ প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সদস্য পাবনার আহমদ রফিক আততায়ীর ছুরিকাঘাতে খুন হয়। তার কিছুদিন আগে খুলনায় মমতাজ নামে আরেকজন আওয়ামী লীগ কর্মী আততায়ীর হাতে নিহত হন। এসব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চরণ করে ২৮ ডিসেম্বর পত্রিকায় একটি বিবৃতি দেন। নিচে বিবৃতি উদ্ধৃত হলো।]

আমি এই নৃশংস হত্যাকান্ডে গভীরভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত, যার ফলে জনগণের সংগ্রামে নিবেদিত নির্ভীক সৈনিক এবং আওয়ামী লীগের দুইজন বিশিষ্ট সদস্যের মূল্যবান জীবনের অবসান ঘটল। আহমদ রফিকের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপই পাবনার জনগণ তাঁকে এম,পি,এ নির্বাচন করেছিলেন। খুলনার মমতাজ ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট কর্মী। আমি এই দুই শহীদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি।

তাঁরা গণ-দুশমন ও ষড়যন্ত্রকারীদের পূর্বপরিকল্পিত ও সুস্থ মস্তিস্ক হত্যাকান্ডের শিকারে পরিণত হয়েছেন। এই অমানুষিক চক্রান্তের পেছনে কোন গণবিরোধী মহল সক্রিয় রয়েছে জনগণের তা অজানা নয়। জঘন্য অপরাধীদের বিচারের জন্যে সত্বর ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে ত্বরিত এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে জনগণের ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে এবং তারা এই সকল গণ-বিরোধী দুস্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানতে পারে।

[সূত্রঃ ইত্তেফাক ও সংবাদ, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০]

 

১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর হোটেল পূর্বানীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশনস-এর সাংস্কৃতিক ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিকী ‘পূর্বানীর ষষ্ঠ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭০ ঢাকার হোটেল পূর্বানীতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রেডিও-টিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্বানী উচ্চকণ্ঠ সমালোচক ছিল। আইয়ুব আমলে পূর্বাণীর প্রকাশনা দীর্ঘদিন সরকারী নির্দেশে বন্ধ রাখা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতি শিল্পী সাহিত্যিকদের দায়িত্বের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তাঁর ভাষণের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]

শিল্পী, সাহিত্যিক এবং কবিদের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খা অবশ্যই প্রতিফলিত করতে হবে। তাঁরা তাঁদের মানুষ, তাঁদের মাতৃভূমি ও সংস্কৃতির জন্যে শিল্পচর্চা করবেন।

জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্যে সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্যে আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছি, শিল্পী, কবি এবং সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে কোন অন্তঃরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে। আজ আমাদের সংস্কৃতির সামনে কোন চক্রান্ত নেই, শাসন বা নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল নেই। শিল্পী-সাহিত্যিকরা আর মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের জন্যে সংস্কৃতিচর্চা করবেন না। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্যে শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেলে সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা যায় না। বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না বলেই বাংলা সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি।

স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্যে প্রায় কিছুই করা যায়নি। শিল্পী, সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতিসেবীদের তাঁদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে মানুষের আশা-আকাঙ্খা প্রতিফলিত করতে দেয়া হয়নি। যে সংস্কৃতির সাথে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই তা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।

ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমাদের জনগণ এই চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। আপনারা সবাই আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানেন।

বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্যে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তানবেতার এবং টেলিভিশনও এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল এবং আজও এ ব্যাপারে উঁচু মহলে জোর আপত্তি রয়েছে। জনগণ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত সহ্য করবে না। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব বাঙ্গালি সরকারী সমর্থন পেয়েছেন, তাঁদের দিন আজ শেষ।

[সূত্রঃ আজাদ, ইত্তেফাক ও সংগ্রাম, ১ জানুয়ারী,১৯৭১]

 

 

আরও পড়ুন: