মুক্তিযুদ্ধে বরিশালের কাঠিরা গণহত্যা (৩০ মে ১৯৭১)

বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম কাঠিরা। স্বাধীনতার পূর্বে পুরো আগৈলঝাড়ায় একটি সাধারণ হাটবাজার ছাড়া বিশেষ পরিচিতি ছিল না। কাঠিরা ছিল একেবারেই সাধারণ একটি গ্রাম, চারদিক থেকে বিল দিয়ে ঘেরা। তাই গ্রামটিকে বলা হতো প্রত্যন্ত বিলাঞ্চল। বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো বাহনে চলাচল সম্ভব ছিল না।

যদিও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণের সময় কাঠিরায় ফসলের মৌসুম চলছিল, তবু ধানক্ষেত পেরিয়ে গ্রামে প্রবেশ করা রাজাকার বা পাক সেনাদের জন্য খুব একটা কঠিন ছিল না।

 

১৯৭১, বরিশালের কাঠিরা গণহত্যা
১৯৭১, বরিশালের কাঠিরা গণহত্যা

 

হত্যাযজ্ঞের সূচনা

১৯৭১ সালের ৩০ মে কাঠিরায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। এর আগের দিন, ২৯ মে শনিবার ছিল গ্রামের হাটবার। সেদিন হাটে বিপুল ভিড় জমেছিল। রিকশাচালক জলিল খাঁর কাছ থেকে জানা যায়, ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে প্রফুল্ল আরিন্দা নামের এক ব্যক্তি (যিনি শান্তিবাহিনীর সহায়কও ছিলেন) গৌরনদী যাওয়ার জন্য ৪০টি রিকশা ভাড়া করেন। খবরে জানা যায়, পরদিন রবিবার ভোরে এই রিকশায় মিলিটারিরা গৌরনদী থেকে কাঠিরায় আসবে। সেই আশঙ্কায় সন্ধ্যার আগেই হাট ভেঙে যায়, আর আতঙ্কগ্রস্ত গ্রামবাসী সারা রাত জেগে কাটায়।

বরিশালের কাঠিরা গণহত্যা, ১৯৭১, বরিশাল কাঠিরা গণহত্যা
বরিশাল কাঠিরা গণহত্যা

 

সাঁড়াশি আক্রমণ

৩০ মে সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা কাঠিরার পূর্ব-উত্তর দিক দিয়ে প্রবেশ করে। তারা ঘোড়ারপাড় গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিক ঘিরে কাঠিরায় সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। এ অভিযানের প্রধান সহযোগী ছিল প্রফুল্ল আরিন্দা।

এর আগে কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রফুল্ল আরিন্দার সঙ্গে এলাকার খ্রীস্টান ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল। পরে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হয়ে ওঠে। প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই সে গ্রামটির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করে।

 

গির্জায় আশ্রয়

গ্রামের অসংখ্য হিন্দু-মুসলিম আতঙ্কে গির্জায় আশ্রয় নেয়। তারা বিশ্বাস করেছিল, গির্জার ভেতরে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেবে না। সেই আস্থার কেন্দ্র ছিলেন গির্জার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাইকেল সুশীল অধিকারী।

কিন্তু উপাসনা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি দল গির্জার পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে এসে পুরো প্রাঙ্গণ ঘিরে ফেলে। আসার পথে তারা তরুণ সেনপাড়ার বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং অনেক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। গির্জার চারপাশে চারটি বড় মেশিনগান তাক করে রাখা হয়।

 

বেছে বেছে হত্যা নির্যাতন

গির্জার ভেতরে বহু নারী-পুরুষকে দেখে পাক সেনারা সন্দেহ করে মুক্তিবাহিনী এখানে লুকানো আছে। তারা শক্তসমর্থ তরুণদের আলাদা করে দাঁড় করায়। মহিলাদের গায়ে ও তলপেটে লাথি মারে। মাইকেল সুশীল অধিকারীকে একজন লাথি মেরে ফেলে দেয় এবং তাঁর পোশাকের ভেতরে অস্ত্র আছে কিনা খুঁজে দেখে।

ইধার হিন্দু হ্যায়?’—এমন প্রশ্নে সুশীল অধিকারী দৃঢ়ভাবে বলেন, এখানে সকলেই খ্রিস্টিয়ান, নমো। ইতিহাস সাক্ষী—সেই উত্তরের কারণেই সেদিন কয়েক শত হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান প্রাণে বেঁচে যায়।

 

হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা

মাইকেল সুশীল অধিকারী পরবর্তীতে বলেন—

“আমি সবাইকে বাঁচাতে পারিনি। শ্যামকান্ত আহাম্মক প্রাণ দিল পাটক্ষেত থেকে মাথা উঁচু করে দেখতে গিয়ে। সতীশের বাবাকে নিষ্ঠুরভাবে মারলো, এরপর সতীশ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিল। এক বৃদ্ধ, যার ঘর থেকে বের হবার শক্তি ছিল না—তাকে ঘরের সঙ্গে পুড়িয়ে দিল। রাইচরণকে হত্যা করল। ঘরের পর ঘর পোড়াল, মা-বোনদের ইজ্জত কেড়ে নিল। পঞ্চাশ জনের ওপরকে নির্মমভাবে হত্যা করল।”

পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন অন্তত ৫০টিরও বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। খোলা জমি দিয়ে পালাতে গিয়ে এক নারী গুলিতে নিহত হন। অলৌকিকভাবে তাঁর কোলে থাকা ৫-৬ মাস বয়সী শিশু বেঁচে যায়। মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর গ্রামবাসী শিশুটিকে মৃত মায়ের দুধপানরত অবস্থায় উদ্ধার করে।

 

পরিণতি স্মৃতি

পাকিস্তানি বাহিনীর এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ কাঠিরাকে শূন্য গ্রামে পরিণত করে। শুধু প্রাণহানিই নয়, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, নারী নির্যাতন চালিয়ে এবং গ্রাম ধ্বংস করে দেয় তারা। কাঠিরার গণহত্যা আজও মুক্তিযুদ্ধকালীন বরিশালের অন্যতম শোকাবহ অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।

 

গ্রন্থতথ্য

কাঠিরার গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন—
📖 কাঠিরা গণহত্যা (গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘন্ট গ্রন্থমালা সিরিজ)

  • লেখক: হিমু অধিকারী
  • প্রকাশক: ১৯৭১ গণহত্যানির্যাতন আর্কাইভ জাদুঘর ট্রাস্ট
  • প্রকাশকাল: পৌষ ১৪২১ / ডিসেম্বর ২০১৪