বাংলাদেশে জরুরী অবস্থার তারিখ সমূহ ও প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় প্রণেতারা একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন—একটি রাষ্ট্র যেখানে কখনও এমন পরিস্থিতি আসবে না যে রাষ্ট্রকে সংবিধানবহির্ভূতভাবে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করতে হবে। সেই কারণে ১৯৭২ সালের সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির কোনও বিধান রাখা হয়নি।

তবে বাস্তবতা ছিল আরও কঠিন। স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি প্রমাণ করে দেয় যে গণতন্ত্রের পাশাপাশি একটি কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জটিল পরিস্থিতিতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আইনি কাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে।

 

বাংলাদেশে জরুরী অবস্থা

 

সংবিধানে সংশোধন ও জরুরি অবস্থার সংযোজন

এই বাস্তবতার আলোকে, ১৯৭৩ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে জরুরি অবস্থা জারির বিধান সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনীর ফলে সংবিধানে নবমভাগ যুক্ত হয়, যার মধ্যে অনুচ্ছেদ ১৮১ (), ১৮১ () ১৮১ () সংযোজন করা হয়। এই ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, জাতীয় নিরাপত্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সংকটকালীন পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে জরুরি অবস্থার ঘোষণার তারিখসমূহ

বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত বার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। প্রতিবারই এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক উত্তেজনা, সরকারবিরোধী আন্দোলন, সামরিক হস্তক্ষেপ অথবা নিরাপত্তা সংকট। নিচে তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

১. ১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় ছিল বাংলাদেশের জন্য এক কঠিন সময়। দেশব্যাপী খাদ্য সংকট, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্নীতির কারণে জনজীবনে নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই সংকট এতটাই বেড়ে যায় যে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়।

 

২. ১৯৮১ সালের ৩০শে মে

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শাসন ব্যবস্থা রক্ষা করতে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এটি ছিল একটি হঠাৎ ও অস্থির সময়, যখন প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার আশঙ্কা ছিল প্রবল।

 

৩. ১৯৮৭ সালের ২৭শে নভেম্বর

এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর লাগাতার আন্দোলন এবং হরতালের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণআন্দোলন ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠলে রাষ্ট্রপতি এরশাদ জরুরি অবস্থা জারি করেন।

 

৪. ১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর

এরশাদ সরকারের পতনের চূড়ান্ত সময়। ছাত্র আন্দোলন ও বিরোধী জোটের যুগপৎ কর্মসূচি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সংঘাতময় করে তোলে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে আবারও জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। তবে, এরশাদ এই ঘোষণার পর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগে বাধ্য হন, এবং দেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।

 

৫. ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি (১/১১)

এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও দীর্ঘস্থায়ী জরুরি অবস্থা। ২০০৬ সালের শেষদিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন জোট ও বিরোধীদের মধ্যে চরম সংঘাত তৈরি হয়। একদিকে সেনাবাহিনীর পরোক্ষ হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির দ্বৈত ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অবশেষে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করেন এবং সেনাসমর্থিত একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সেই সঙ্গে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, যা প্রায় দুই বছর স্থায়ী ছিল। এই সময়কালে বহু রাজনৈতিক নেতা গ্রেপ্তার হন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালানো হয় এবং কিছু সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়।

 

বাংলাদেশে জরুরি অবস্থার ঘোষণা প্রতিবারই একটি সংকটকালীন সময়কে চিহ্নিত করে। এটি কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা থেকে, কখনও রাজনৈতিক সহিংসতা দমন করতে, আবার কখনও ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার ফলে জারি হয়েছে। সংবিধানে জরুরি অবস্থার বিধান যুক্ত করা হলেও, এর ব্যবহার নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা বিতর্ক রয়েছে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জরুরি অবস্থার মতো পদক্ষেপ অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটি গণতান্ত্রিক অধিকার সীমিত করে। তাই ভবিষ্যতে যাতে আর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে জন্য প্রয়োজন একটি সুসংহত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা।