বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনেক অজানা যুদ্ধ ও সংঘর্ষ রয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে সংঘটিত হলেও কৌশলগতভাবে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইছামতির যুদ্ধ এমনই একটি অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর নীলফামারীর দারোয়ানী-খানসামা সড়কে ইছামতি নদীর তীরে সংঘটিত এই যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
![Ichamati river at Basirhat city ব্যাটেল অব ইছামতি, ১৩ ডিসেম্বর 2 ব্যাটেল অব ইছামতি [Battle of Ichamati River ] - Ichamati river at Basirhat city](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2021/12/Ichamati-river-at-Basirhat-city-300x225.jpg)
গবেষণা ও তথ্যসূত্র
এই প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে আমি যে তথ্যগুলো ব্যবহার করেছি, তার অধিকাংশই সংগ্রহ করেছি মিত্রবাহিনীর ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার প্রয়াত পি. এন. কাথাপালিয়া এবং ২১ রাজপুত ব্যাটালিয়নের লে. কর্নেল এস. জি. ডালভি সাহেবের সঙ্গে আলাপচারিতা ও সাক্ষাৎকার থেকে। তাঁদের দেওয়া তথ্য ও বর্ণনা ব্যবহার করেই ইছামতির যুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
![Lt Gen PN Kathpalia ব্যাটেল অব ইছামতি, ১৩ ডিসেম্বর 3 Lt Gen PN Kathpalia [ ব্যাটেল অব ইছামতি, Battle of Ichamati River ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2021/12/Lt-Gen-PN-Kathpalia.jpg)
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত করতে অগ্রসর হয়। পি. এন. কাথাপালিয়ার নেতৃত্বাধীন বাহিনী শিলিগুড়ি থেকে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় দখল করার পর রাতভর গোলাবর্ষণ চালাতে থাকে। তীব্র চাপের মুখে পাকিস্তানি সেনারা ঠাকুরগাঁও ছেড়ে পিছু হটে যায়।
তাদের একাংশ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়, আরেকাংশ অবস্থান নেয় দিনাজপুরের খানসামায়। খানসামা থেকে নীলফামারী খুব কাছেই হওয়ায়, মিত্রবাহিনী দ্রুত অগ্রসর হয়ে নীলফামারীর সীমান্তে ইছামতি নদীর তীরে পৌঁছে যায়। ডিসেম্বরের শীতে, হিমালয়ের পাদদেশে, ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের লক্ষ্য ছিল একেবারে স্পষ্ট—সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট দখল।
![Ichamati river Nadia River The lower Ichamati channel flows criss cross through India and Bangladesh ব্যাটেল অব ইছামতি, ১৩ ডিসেম্বর 4 ব্যাটেল অব ইছামতি [Battle of Ichamati River ] - Ichamati river, Nadia River, The lower Ichamati channel flows criss-cross through India and Bangladesh](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2021/12/Ichamati-river-Nadia-River-The-lower-Ichamati-channel-flows-criss-cross-through-India-and-Bangladesh-159x300.jpg)
পরিকল্পিত অভিযান
দিনাজপুর জেলার খানসামা থেকে নীলফামারী মহকুমার দারোয়ানী সড়কের ইছামতি নদীর ব্রিজের পাশে সংঘটিত এই যুদ্ধে অংশ নেয় ভারতের ৩৩ কর্পসের জিওসি লে. জেনারেল এম. এল. থাপার এর অধীনস্থ ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেড।
পি. এন. কাথাপালিয়া শিলিগুড়ি হেডকোয়ার্টার থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন—পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও দখল করে নীলফামারী হয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করা।
১৩ ডিসেম্বর খানসামা বিজয়ের পর ২১ রাজপুত ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যেন খানসামা-দারোয়ানী সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে কাজ করে। কৌশলগত পরিকল্পনা ছিল—উত্তর-পূর্ব দিক থেকে খানসামা-দারোয়ানী সড়ক বরাবর এবং উত্তর দিক থেকে রংপুর-সৈয়দপুর সড়ক বরাবর সৈয়দপুর শহরকে ঘিরে ফেলা।
![lieutenant general m l thapan ব্যাটেল অব ইছামতি, ১৩ ডিসেম্বর 5 lieutenant general m l thapan [ ব্যাটেল অব ইছামতি, Battle of Ichamati River ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2021/12/lieutenant-general-m-l-thapan-257x300.jpg)
প্রতিরক্ষা অবস্থান
সৈয়দপুর ছিল পাকিস্তানি সেনাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সেনানিবাস। খানসামা থেকে সৈয়দপুর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পথে বড় প্রতিবন্ধক ছিল ইছামতি নদী। পাকিস্তানি সেনারা এখানে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেছিল।
এই প্রতিরক্ষা দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানের ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন। তারা লোকালয়ের প্রতিরক্ষা সুসংগঠিত করতে দুই প্রান্তে দুটি কোম্পানি মোতায়েন করে। এক কোম্পানি অবস্থান নেয় ইছামতি নদীর তীরে, আরেকটি প্রায় এক হাজার গজ পূর্বে খড়খড়িয়া নদীর প্রান্তে। এই খড়খড়িয়ার প্রতিরক্ষা পরবর্তী যুদ্ধে (যা এই প্রবন্ধের পরের অংশে আলোচনা করা হবে) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
![Boat On the Ichhamati From Taki Saidpur ব্যাটেল অব ইছামতি, ১৩ ডিসেম্বর 6 ব্যাটেল অব ইছামতি [Battle of Ichamati River ] - Boat On the Ichhamati From Taki Saidpur](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2021/12/Boat-On-the-Ichhamati-From-Taki-Saidpur-300x225.jpg)
মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি
ইছামতির যুদ্ধের জন্য ব্যাটালিয়নকে কয়েকটি ট্রুপে বিভক্ত করা হয়—
আন্ডার কমান্ড ট্রুপ: এতে ছিল দুই ফৌজের কম ডি স্কোয়াড্রন (অ্যাডহক) এবং ৬৯ আর্মার্ড রেজিমেন্ট।
প্রত্যক্ষ সহায়তা ট্রুপ: এর আওতায় ছিল এক গোলন্দাজ বহরের কম ৯৮ মাউন্টেন রেজিমেন্ট, দুই গোলন্দাজ বহরের কম ৫৪ মাউন্টেন রেজিমেন্ট এবং ৫.৫ ইঞ্চি মাঝারি বন্দুকধারী সাবেক ৪৬ মিডিয়াম রেজিমেন্ট।
আকাশ পথ ট্রুপ: এর মধ্যে ছিল অন-ডিমান্ড ক্লোজ সাপোর্টের তিনটি সর্টি এবং হেলিকপ্টারবাহিত আকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র।

যুদ্ধের সূচনা
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় খানসামা-দারোয়ানী সড়কের ব্রিজ এলাকা থেকে আক্রমণ শুরু হয়। ভ্যানগার্ড বাহিনী ছিল ২১ রাজপুত ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি।
১৪ ডিসেম্বর দুপুর ২টা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কিন্তু মিত্রবাহিনীর ভ্যানগার্ড এবং সাঁজোয়া বাহিনী জঙ্গল থেকে বের হয়ে ইছামতি ব্রিজের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি সেনারা ভারী কামান ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে প্রবল গোলাবর্ষণ শুরু করে।
কৌশলগত পরিস্থিতি ও পাকিস্তানি মোতায়েন
ইছামতি নদীর ব্রিজ এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। গোলাবর্ষণের ধরণ এবং সেনা মোতায়েন দেখে ব্রিগেডিয়ার পি. এন. কাথাপালিয়া অনুমান করেন—প্রায় একটি কোম্পানি (৮০–১৫০ জন সৈন্য) পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে অবস্থান করছে এবং তারা সুরক্ষিত বাঙ্কার থেকে আক্রমণ চালাচ্ছে।
কাথাপালিয়া বুঝতে পারেন, সামনের দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ করে কোনো সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরদিক থেকে দ্রুত আক্রমণ চালানো যেত, তবে তিনি দুটি কারণে অগ্রসর হতে নিষেধ করেন—
১. মিত্রবাহিনীর মাউন্টেন গানগুলি যথেষ্ট দূরপাল্লার ছিল না, আর ইঞ্জিনিয়াররা তখনও খানসামায় বুড়িতিস্তার ওপর ভাসমান সেতু নির্মাণে ব্যস্ত থাকায় নদী অতিক্রম অসম্ভব ছিল।
২. আকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে খবর আসে—ইছামতি নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে দিনাজপুরের পাকেরহাট এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের একটি বহরের গতিবিধি লক্ষ্য করা গেছে।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কাথাপালিয়া ৫ জন গ্রেনেডিয়ারকে পাকেরহাট–সুটিপাড়া–দারোয়ানী রেলস্টেশনের দিকে পাঠান, যাতে রাজপুত রাইফেলসের দক্ষিণ অংশ সুরক্ষিত রাখা যায়।
![Battle of Ichamati River ব্যাটেল অব ইছামতি, ১৩ ডিসেম্বর 8 [ ব্যাটেল অব ইছামতি, Battle of Ichamati River ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2021/12/Battle-of-Ichamati-River-300x180.jpg)
মিত্রবাহিনীর আক্রমণ পরিকল্পনা
২১ রাজপুত ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেওয়া হয় ইছামতি দখলের জন্য পর্যায়ক্রমিক আক্রমণ চালাতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী—
প্রথম ধাপ: ‘ডি’ কোম্পানি ইছামতি ব্রিজ এলাকা দখল করবে।
দ্বিতীয় ধাপ: ‘সি’ কোম্পানি ১৩-আর এলাকা দখল করবে।
রিজার্ভ: ‘বি’ কোম্পানিকে রিজার্ভে রাখা হয়।
অতিরিক্ত দায়িত্ব: এক প্লাটুনকে নিকটবর্তী স্থান থেকে গোলাবর্ষণ সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পাশাপাশি ‘এ’ কোম্পানির একটি প্লাটুন এবং ডি স্কোয়াড্রনের তিনটি ট্রুপকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানের ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নকে পেছন থেকে আক্রমণ করে ব্রিজের দুই পাশে ও স্থানীয় মসজিদ এলাকায় তাদের আটকে ফেলার।
এ সময় গাছপালা ও ঘনবসতির কারণে শত্রুপক্ষের সুনির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই মিত্রবাহিনী আকাশ পর্যবেক্ষণের সহায়তা নেয়।
আক্রমণের সূচনা
বি কোম্পানি এফইউপি (Forming Up Place)-তে পৌঁছাতে দেরি হলেও মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত ইউনিট তাদের অবস্থানে পৌঁছে যায়। বিকেল ৪টার পরপরই পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ শুরু হয়।
ডি কোম্পানি সরাসরি আক্রমণ চালায় পাকিস্তানের ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে।
পাকিস্তানি সেনারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে, বাঙ্কার থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং কামানবিদ্ধংসী গোলা ছোড়ে।
প্রায় ৩০ মিনিটের তুমুল যুদ্ধের পর, মিত্রবাহিনী অক্ষত অবস্থায় ইছামতি ব্রিজ দখল করতে সক্ষম হয়।
যুদ্ধের ফলাফল
মিত্রবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকিস্তানি সেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তারা পিছু হটে খড়খড়িয়া নদীর দিকে আশ্রয় নেয়। ফলে দ্বিতীয় ধাপের আক্রমণের প্রয়োজন পড়েনি।
নীলফামারীর সবুজ প্রান্তরে শীতের গোধূলি লগ্নে সংঘটিত এই মল্লযুদ্ধে পাকিস্তানের ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। তাদের রক্তাক্ত নিথর দেহ ইছামতি নদীর তীরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে।

ঐতিহাসিক তাৎপর্য
ইছামতির যুদ্ধ মাত্র কয়েক ঘন্টার হলেও কৌশলগত দিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি সেনারা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট রক্ষার শেষ চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু মিত্রবাহিনীর শৃঙ্খলিত পরিকল্পনা, দ্রুত আক্রমণ ও অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার মুখে তারা ভেঙে পড়ে।
ব্যাটেল অব ইছামতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রমাণ করে, সঠিক কৌশল, মনোবল ও দৃঢ় নেতৃত্ব থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই একটি সুসংগঠিত প্রতিরক্ষা ভেঙে দেওয়া সম্ভব।
