তানসেনের দীপক রাগ

তানসেনের দীপক-মালহার নিয়ে যারা গল্প শুনেছেন—আগুন জ্বালানো দীপক, আর তার জ্বালায় দগ্ধ তানসেনকে বাঁচাতে মেঘ ডেকে আনা মালহার—তাঁরা যদি সরাসরি সেই অভিজ্ঞতা না-ও পান, তবে গ্রীষ্মের দুপুরে মান্না দে-র কণ্ঠে “প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন” গানটি শুনে অন্তত সেই রসের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেন। গানটি গড়ে উঠেছে দীপক রাগের আশ্রয়ে।

আমাদের দুর্ভাগ্য, তানসেনের সেই কিংবদন্তি-খ্যাত দীপকের কোনও প্রামাণ্য স্বরলিপি আজ আর নেই। ফলে সুনির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব—তাঁর দীপকের আরোহ-অবরোহ, বাদী-সমবাদী, গতি বা চলন কেমন ছিল। ঘরানাদার সঙ্গীতস্রোতের মধ্য দিয়ে শুধু কিংবদন্তির টুকরো টুকরো রূপ আমাদের কাছে পৌঁছেছে।

পণ্ডিত ভাতখান্ডে তাঁর রাগতত্ত্বে দু’ধরনের দীপকের উল্লেখ করেছেন—

  • একটি পুরবী ঠাটে,

  • অপরটি বিলাবল ঠাটে
    আবার অন্য কিছু প্রাচীন সূত্রে খাম্বাজ ঠাটের সঙ্গেও দীপকের সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়।

এ থেকে বোঝা যায়, দীপক একক কোন বাঁধাধরা রূপে আবদ্ধ নয়, বরং যুগে যুগে তার নানান বৈচিত্র্যময় রূপ সঙ্গীতজ্ঞরা পরিবেশন করেছেন।

আধুনিক কালে পণ্ডিত রামাশ্রেয় ঝা যে রূপটি দেখিয়েছিলেন, তাতে বিশেষ করে পঞ্চম থেকে ধৈবতকে ধাক্কা দিয়ে ধরে আবার পঞ্চমে ফেরা—এই অনন্য ছন্দকৌশল শ্রোতাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কানে সেটিই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও জীবন্ত মনে হয়েছে।

তানসেনের দীপক

কথিত আছে, দীপক এমন এক রাগ যা পরিবেশিত হলে পরিবেশ গরম হয়ে ওঠে, এমনকি প্রদীপ জ্বলে ওঠে। যদিও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এগুলো কিংবদন্তি মাত্র, তবে সঙ্গীতের আবহ ও শক্তি যে মানুষের চেতনায় প্রভাব ফেলতে পারে, তা অনস্বীকার্য। সম্ভবত এ কারণেই দীপককে “আগুনের রাগ” বলা হয়।

তানসেনের দীপক আজ আর সরাসরি শোনা সম্ভব নয়, কিন্তু তার কিংবদন্তি আমাদের কল্পনায় এখনো জ্বলে। বিভিন্ন ঘরানা, বিভিন্ন ঠাটে দীপকের বিচিত্র রূপ সঙ্গীতানুরাগীদের আলোড়িত করে চলেছে। আর আধুনিক সময়ে মান্না দে-র মতো শিল্পীরা সেই রসের একটি ঝলক আমাদের কাছে পৌঁছে দেন।

আরও দেখুন: