বিজ্ঞাপনকে বলা হয় সমাজের অনুভূতির প্রথম আয়না। একবার তাকালেই বোঝা যায় সমাজের আসল অবস্থা! এই সমাজ কেন বেঁচে আছে, আর কেন মরছে — তার উত্তরও মেলে সেখানে।
একসময় বিজ্ঞাপন মানে ছিল গল্প — যে গল্পে প্রতিফলিত হতো আমরা কারা, আর কী হতে চাই। সেখানে পণ্যের চেয়ে মানুষ বড় ছিল, বাণিজ্যের চেয়ে মানবিকতা। একসময় সাবান বিক্রি হতো মায়ের যত্নের গল্পে, কাপড় বিক্রি হতো একসঙ্গে থাকার উষ্ণতায়, গাড়ি বিক্রি হতো বন্ধুত্বের যাত্রায়। বিজ্ঞাপন ছিল ভালোবাসা, সহানুভূতি ও বিশ্বাসের বার্তাবাহক। সেই সময়, ব্যবসার ভেতরেও ছিল একধরনের মানবিক সুর — যা বাণিজ্যকে কবিতায় রূপ দিত।
বিগত ১৮–১৯ বছরে যেন সবকিছু বদলে গেল — ধীরে ধীরে, ক্রমশ। প্রযুক্তির কারণে হোক আর সামাজিক অবক্ষয়েই হোক । আজকের বিজ্ঞাপন এখন আর মানুষকে মানবিক হতে আহ্বান জানাচ্ছে না; বরং তাকে আরও উচ্চাভিলাষী, আরও অস্থির, আরও অপ্রসন্ন করে তুলছে। আজকের বিজ্ঞাপন আমাদের ভয় দেখিয়ে পণ্য বিক্রি করে, হীনমন্যতা জাগিয়ে চাহিদা তৈরি করে, লোভ ও প্রতিযোগিতাকে প্ররোচিত করে। সাবান বিক্রি হয় “অপূর্ণতার ভয়” দেখিয়ে, ফোন বিক্রি হয় “পুরনো হয়ে পড়ার আতঙ্কে”, গাড়ি বিক্রি হয় “অন্যের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার তাড়নায়”। বার্তাটি একটাই— “তুমি যথেষ্ট নও, যদি কিনে না ফেলো আরও কিছু।”
এমন সমাজে ভয় পণ্যের কৌশল হয়ে দাঁড়ায়, আর লোভ হয় নতুন সংস্কৃতি। কিন্তু যখন মানুষ ভয় দিয়ে কিনতে শেখে, তখন ভয় দিয়েই বাঁচতে শুরু করে। যখন সমাজ লোভ দিয়ে ক্রয় করে, তখন লোভ দিয়েই শ্বাস নেয়। এ এক নীরব কিন্তু ভয়ংকর পরিবর্তন—যেখানে বিজ্ঞাপন শুধু পণ্য নয়, মানুষের মানস গঠন করে, নৈতিকতাকে প্রতিদিন অল্প অল্প করে ক্ষয় করে।
নৈতিকতার এই ক্ষয় কেবল নৈতিক সমস্যা নয়—এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাও। যেখানে সততা হারায়, সেখানে বিশ্বাস উধাও হয়। যেখানে বিশ্বাস ভাঙে, সেখানে বিনিয়োগ সরে যায়। যেখানে সহানুভূতি মরে, সেখানে উৎপাদনশীলতা কমে। ভয় ও লোভের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো বাজার দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, কারণ তা স্থিতিশীলতা নয়, অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। নৈতিকতার ঘাটতি সমাজকে এমন এক ব্যাংকে পরিণত করে, যার ভল্ট খালি—নোট আছে, কিন্তু মূল্য নেই।
তাই আমাদের বুঝতে হবে—মূল্যবোধ কোনো বিলাসিতা নয়; এটি সমাজের আসল পুঁজি। আমরা যেমন ব্যাংকে টাকা জমাই ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য, তেমনি সমাজে নিয়মিতভাবে নৈতিকতা জমা দিতে হয় ভবিষ্যতের মানবিক নিরাপত্তার জন্য। সততা হলো সুদ, সহানুভূতি হলো বিনিয়োগ, আর মমতা যখন চর্চায় বাড়ে, তখন সমাজ স্থিতিশীল হয়। যদি কোনো সমাজ এসব নৈতিক মুদ্রা জমা রাখা বন্ধ করে, তবে সেটি দেউলিয়া হয়ে যায়—নৈতিকতায়, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে। তখন রয়ে যায় শুধু চকমক, কিন্তু থাকে না কোনো আলো; থাকে পণ্য, কিন্তু থাকে না মানুষ।
বিজ্ঞাপন এক অর্থে সমাজের পাঠ্যপুস্তক। প্রতিটি জিঙ্গেল, প্রতিটি স্লোগান শেখায় এক একটি দর্শন। এক শিশু যখন বারবার দেখে যে সাফল্য মানে বিলাসিতা, সৌন্দর্য মানে মূল্য, আর প্রতিযোগিতা মানে বেঁচে থাকা—তখন সে ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শেখে, মানুষ নয়, পণ্যই জীবনের অর্থ। কিন্তু যদি সে দেখে, বিজ্ঞাপনে ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সততা ও মানবিকতার গল্প বলা হচ্ছে—তাহলে সে শেখে, সুখ জিনিস নয়, অনুভূতি; মূল্য ধন নয়, মর্যাদা।
এ কারণেই আমরা চাই, বিজ্ঞাপন নির্মাতারা এবং দর্শকরা—উভয়েই—ভাবুক, গভীরভাবে ভাবুক। বিজ্ঞাপনকারীদের উদ্দেশে বলি—আপনার সৃজনশীলতা যেন বিবেকনির্ভর হয়। ভয় বা লোভের মাধ্যমে নয়, মানবতার আলোয় পণ্য বিক্রি করুন। আপনি শুধু বাণিজ্য করছেন না, আপনি সমাজের সংস্কৃতি নির্মাণ করছেন। আপনার প্রতিটি গল্প, প্রতিটি ছবি জাতির চেতনায় ছাপ রেখে যায়।
আর দর্শকদের বলি—আপনি কেমন বিজ্ঞাপনকে পুরস্কৃত করছেন? যে বিজ্ঞাপন আপনাকে হীনমন্যতা শেখায়, সেটি সমাজকে আরও দুঃখী করে। কিন্তু যে বিজ্ঞাপন আপনাকে সহানুভূতি, মানবিকতা বা সত্যের পথে নিয়ে যায়—সেটিই আসলে সমাজের পক্ষে আপনার বিনিয়োগ। আপনি যা দেখছেন, তাই একদিন আপনার সন্তান বিশ্বাস করবে।
বিজ্ঞাপন কোনো অর্থে সমাজের আয়না। সেটি আমাদের কেনাকাটার পছন্দ নয়, আমাদের চিন্তার মানচিত্র প্রতিফলিত করে। যদি সেই আয়নায় বিকৃতি দেখা দেয়, তবে ত্রুটি কেবল স্ক্রিনে নয়—আমাদের মধ্যেও। এখনই সময় সেই আয়নাকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার, এবং বাণিজ্যকে আবার অর্থবহ গল্পে রূপ দেওয়ার।
আমাদের সবার দায়িত্ব—বিজ্ঞাপন যেন শুধুই বিক্রির মাধ্যম না হয়, বরং সমাজের সৌন্দর্য, সততা ও মমতার ধারক হয়ে ওঠে। আমরা ব্যাংকে টাকা জমাই ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য; এবার আসুন, হৃদয়ে জমাই নৈতিকতা—মানবতার ভবিষ্যতের জন্য।
একটি জাতির অগ্রগতি শুধু তার অর্থনীতির পরিসংখ্যানে মাপা যায় না; মাপা যায় তার নৈতিক মুদ্রায়—তার মানুষ কতটা সহানুভূতিশীল, কতটা সৎ, কতটা মানবিক।
যদি বিজ্ঞাপন সত্যিই সমাজের আয়না হয়, তবে প্রশ্ন একটাই—আমরা যখন সেই আয়নায় তাকাই, তখন কি এখনও নিজেদের চিনতে পারি?