মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দিল্লি জামা মসজিদে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা করেন। সেই বক্তৃতাটি পড়লে ভারত-পাকিস্তানের পার্টিশন, তার প্রেক্ষাপট এসব অনেক স্পষ্ট হবে। মাওলানা বক্তৃতাটি করেছিলেন উর্দুতে। আমার উর্দু জ্ঞান একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। তার পরেও বক্তৃতাটি এক সাথে ক্রমানুযায়ী অডিও পাওয়া যায় না। উর্দুর শাব্দিক অনুবাদ করলে আবার অনেক কিছু উহ্য থেকে যায়, শুধুমাত্র বাংলা বোঝা পাঠক যে কারণে পুরো বিষয়টি অনুভব করতে পারবে না। আমি একটা অনুবাদ করে দেবার চেষ্টা করলাম কারণ আমি মনে করি প্রতিজন মুসলিমের এই বক্তৃতাটি অবশ্যপাঠ্য । ভুল ভ্রান্তির জন্য অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের দিল্লি জামা মসজিদের ঐতিহাসিক বক্তৃতা
আমার ভায়েরা, আমার প্রিয়জন,
তোমরা জানো আজ এখানে আমাকে কি টেনে এনেছে। শাহজাহানের এই ঐতিহাসিক মসজিদের এই জামাত আমার কাছে তো নতুন নয়। এখানে, এখানে আমি এই আগেও কয়েকবার তোমাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেছি। তারপর থেকে আমরা অনেক উত্থান -পতন দেখেছি। সেই সময়ে – ক্লান্তির পরিবর্তে তোমাদের মুখে প্রশান্তি ছিল, তোমাদের হৃদয়ে কুসংস্কারের পরিবর্তে আত্মবিশ্বাস ছিল। আজ তোমাদের মুখের অস্বস্তি এবং হৃদয়ের শূন্যতা, যা আমি আজ দেখছি, তা আমাকে গত কয়েক বছরের ঘটনাগুলো আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
মনে আছে তোমাদের?
আমি যখন তোমাদের ডেকেছিলাম, তোমরা আমার জিহ্বা কেটে দিয়েছিলে;
আমি যখন কলম তুলেছিলাম, তোমরা আমার হাত দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছিলে;
আমি হেটে আগাতে চাইছিলাম, তোমরা আমার পা ভেঙ্গে দিলে;
আমি যখন ঘুরো দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, তখন তোমরা আমার কোমর ভেঙ্গে দিলে।
গত সাত বছরের তিক্ত রাজনৈতিক খেলা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছল, তখন আমি তোমাদের প্রতিটি বিপদে সংকেত দিয়েছি, জাগানোর চেষ্টা করেছি।
তোমরা শুধু আমার আহ্বান উপেক্ষাই করোনি । বরং উপেক্ষা এবং অস্বীকারের অতীতের যে পুরনো ঐতিহ্য তাকে তোমরা পুনরুজ্জীবিত করেছ।
ফল কি হলো? আজ তোমরা সেই একই পরিস্থিতিতে ঘিরে আছো, অতীতে যেভাবে তোমরা অধর্মের পথ চলার সূচনা করেছো, বিপদে পড়েছ।
আজ, আমার কথা একটি জড় অস্তিত্ব বা একটি হতাশার কান্না ছাড়া আর কিছুই নয়; আমি আমার নিজের মাতৃভূমিতে এতিম।
এর অর্থ এই নয় – যে আমি নিজের জন্য যে বেছে নেয়া ফাঁদে আটকে পড়েছি, বা আমি মনে করি না যে আমার নীড়ের [আশিয়ানা =বাসা] এর জন্য কোনও জায়গা অবশিষ্ট নেই।
এর মানে হল – তোমাদের নির্বোধ হাতের শক্তি হবার জন্য আমার চাদর/পাগড়ি আর যথেষ্ট নয়।
আজ আমার সংবেদনশীলতা আহত, আমার হৃদয় ভারী।
এক মুহূর্ত ভাবো।
কোন রাস্তা ধরেছ তোমরা? কোথায় গিয়ে পৌঁছেছ, আর এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছ?
তোমাদের ইন্দ্রিয় কি অস্থির হয়ে উঠেনি?
তোমরা কি অবিরাম ভয়ের মধ্যে বসবাস করছেন না?
মনে করে দেখ – এই ভয় তোমার নিজের সৃষ্টি, তোমাদের নিজের কর্মের ফল।
খুব বেশি দিন আগের কথা না, আমি যখন তোমাদের সতর্ক করেছিলাম, যে দ্বি-জাতি তত্ত্ব একটি অর্থপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য মৃত্যুপুরী, এটা অবিলম্বে ত্যাগ করো। আমি তোমাদের বলেছিলাম যে, যে স্তম্ভগুলির উপর তোমরা নির্ভর করছো সেগুলো অনিবার্যভাবে ভেঙে পড়বে। আমি তোমাদের ও বধির কানে কোন কথা ঢুকাতে পারিনি ।
তোমরা এটা বুঝতে পারনি, আমার ভাইয়েরা!
আমি সবসময় রাজনীতিকে আমার ব্যক্তিত্ব থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করেছি, এইভাবে সেই কাঁটাযুক্ত উপত্যকাগুলি এড়িয়ে চলতে চেয়েছি। তোমাদেরকে আমি প্রায়ই বার্তা দিয়েছি, ইঙ্গিত দিয়েছি।
ভারত ভাগ একটি মৌলিক ভুল ছিল।
তবে যেভাবে ধর্মীয় বিভেদ উসকে দেওয়া হয়েছিল, অনিবার্যভাবে, সেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল যা আমরা নিজের চোখে দেখেছি। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এখনও কিছু জায়গায় এটি দেখতে পাচ্ছি।
বিগত সাত বছরের ঘটনা পুনর্বিবেচনা করে কোন লাভ নেই, বা আমাদের হয়ত কোন ক্ষতিবৃদ্ধিও হবে না। তবুও, এটা অবশ্যই বলা উচিত যে ভারতীয় মুসলিমদের পরাজয়, মুসলিম লীগের বিপথগামী নেতৃত্বের দ্বারা সংঘটিত বিশাল ভুলের ফল। যাইহোক, এই ফলাফলগুলিতে আমি অবাক হইনি; আমি প্রথম থেকেই এমনই হবে জানতাম।
এখন যেহেতু ভারতীয় রাজনীতি নতুন মোড় নিয়েছে, তাতে মুসলিম লীগের কোন স্থান নেই। এখন প্রশ্ন হল, আমরা নিজেরা গঠনমূলক চিন্তা -ভাবনায় সক্ষম কি না! এ জন্য আমি ভারতের মুসলিম নেতাদের দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে।
তোমাদের জীবনে যে বিষণ্ণতা এসেছে তা ক্ষণস্থায়ী।
তবে আমি তোমাদের আশ্বাস্ত করছি – আমরা নিজেরা ছাড়া অন্য কেউ আমাদের পরাজিত করতে পারবে না! আমি অতিতে সবসময় বলেছি, আবারও পুনরাবৃত্তি করছি;- তোমাদের অনিশ্চয়তা, তোমাদের অবিশ্বাস এবং তোমাদের অপকর্ম এখনি বন্ধ করো। এই অনন্য ত্রি-মুখওয়ালা ধারালো অস্ত্রটি, দুই ধারের লোহার তলোয়ারের চেয়েও মারাত্মক, মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করে, যার কথা পুর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি!
শুধু একবার ভেবে দেখ – হিজরতের পবিত্র নামটি তুমি ব্যবহার করছ তোমার পলায়নবাদের জীবনের জন্য। তোমার নিজের মস্তিষ্ক এবং তোমার নিজের হৃদয়কে শক্তিশালী করার অভ্যাস করো। তোমরা যদি সেটা করতে পারো তাহলে বুঝতে পারবে তোমাদের সিদ্ধান্তগুলি কতটা অপরিপক্ব ছিল।
তোমরা কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ?
চোখ তুলে তাকাও।
জামে মসজিদের মিনারগুলো তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চায়।
তুমি তোমার ইতিহাসের সেসব গৌরবময় পাতাগুলি কোথায় হারিয়ে ফেললে?
এই তো গতকাল না! তোমার কাফেলারা যমুনার ধারে উজু করেছিল?
আজ, তোমরা এখানে বসবাস করতে ভয় পাচ্ছ!
মনে রাখবে, দিল্লিকে তোমাদের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ভাই আমার!
নিজের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন করো।
আজ, তোমার আজকের অহেতুক ভয় একটা ভুল, যেমন ভুল ছিল তোমার গতকালের আনন্দ।
ভীরু এবং উন্মাদ শব্দটি মুসলিম শব্দের মতো একই নিশ্বাসে বলা যাবে না। একজন সত্যিকারের মুসলমানকে হতাশা বা শঙ্কা দিয়ে দমন করা যায় না।
কিছু মুখ আর দেখছেন না বলে ভয় পেয়ো না। তারা তোমাকে ছেড়ে একা পালিয়ে গেছে তাদের নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে। আজ, যদি হাত ঝাড়া নিয়ে তোমার থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়, তাতে তোমার কি আসে যায়? শুধু নিশ্চিত করো যে তারা তোমার হৃদয় নিয়ে পালিয়ে যায়নি।
যদি তোমার হৃদয় এখনও ঠিক জায়গায় থাকে, তাহলে সেটাকে আল্লাহর আবাসস্থল বানাও।
প্রায় তেরোশো বছর আগে, আরব উম্মির মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা করেছিলেন : “যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের বিশ্বাসে দৃঢ় থাকে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই বা কোন দুঃখ নেই।”
বাতাস বইতে থাকবে, মেঘগুলোও হয়ত একত্রিত হবে, কিন্তু এসব খুবই ক্ষনস্থায়ী। বিচারের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। নিজেকে এমনভাবে পরিবর্তন করো যেন যেন তুমি কখনোই এরকম খারাপ অবস্থায় ছিলে না।