সাম্প্রতিক ঢাকায় শেষ হল সিআইও সামিট ২০১২ । এর আগে তথ্য প্রযুক্তি পেশাজীবীদের বিভিন্ন সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি প্রধানদের সম্মেলনও হয়েছে। তবে শুধুমাত্র সিআইও বিষয় ও সিআইওদের নিয়ে সম্মেলন বাংলাদেশে এটাই প্রথম । দেশীয় ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান আই-স্টেশন লিমিটেড এবং ইউ বি এম ইন্ডিয়া এর যৌথ উদ্যোগে গত ৮ নভেম্বর ২০১২ ইং তারিখে সন্ধ্যা ৬ টায় রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে “বাংলাদেশ সি আই ও সামিট ২০১২” অনুষ্ঠিত হয় ।
সিআইও সামিট ২০১২ বাংলাদেশ
সম্মেলনটিতে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী সরকারী, বেসরকারি, আর্থিক সেবা প্রদান কারী প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সি.টিও/সি.আই.ও/ হেড অফ আইটি/ আইটি ম্যানেজার অথবা সম পদবীর পেশাজীবীরা তাদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত প্রযুক্তিবিদদের সাথে তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের বিনিময়ের মাধ্যমে কিভাবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেন ।
এই নেটওয়ার্কিং সম্মেলনটিতে উদ্বোধনী এবং প্রযুক্তিগত দুইটি সেশন সহ গালা ডিনার অনুষ্ঠিত হয় । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর বাংলাদেশের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক জনাব টি আই এম নুরুল কবির, বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এর সাধারণ সম্পাদক জনাব মুনির হাসান এবং জনাব সুমন আহমেদ সাবির, সি এস ও, ফাইবার এট হোম এবং পরামর্শক, বিডিকম অনলাইন লিমিটেড ।
প্রযুক্তিগত অধিবেশনে জনাব টি আই এম নুরুল কবির মূল বক্তব্য পেশ করবেন । এছাড়াও জনাব প্রাভীন কান্ডিকুপ্পা, প্রধান এসই-ইন্ডিয়া, ফ্লুক নেটওয়ার্কস, জনাব সত্য কল্যাণ মোহানিত্ম, চ্যানেল ম্যানেজার, চেক পয়েন্ট সফটওয়্যার টেকনোলজিস এবং জনাব অলক আনন্দ, প্রধান বিপণন কর্মকর্তা-ইন্ডিয়া ও সার্ক, পলিকম টেকনিক্যাল প্রেজেন্টেশন প্রদান করেন । অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিটি পরামর্শক, লেখক, টিভি ব্যক্তিত্ব এবং ব্যাবসায়িক পরামর্শক জনাব সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর। এছাড়াও প্রশ্নোত্তর এবং নেটওয়ার্কিং সেশনে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয় ।
আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল CIO ধারনাটিকে জনপ্রিয় করা। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা প্রধানদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন। তাদের পরস্পরের অভিজ্ঞতা বিনিময় ও অন্য দেশের প্রযুক্তিবিদদের সাথে মত বিনিময়। আয়োজনের মধ্যে ছিল – উদ্বোধনী, কারিগরি সেশন, নেটওয়ার্কিং সহ রাতের খাবার। আয়োজক ছিল ইউভিএম নামের একটি বিদেশি ও আই স্টেশন নামের দেশি কোম্পানি। তারা বিগত বছরগুলোতে অন্যান্য দেশে এধরনের সামিটের আয়োজন করে আসছে।
শুরু দিকে স্পন্সরের অভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এসব আয়োজনে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। বাজার তৈরি হবার পর তারা নিয়মিত আয়োজনের আগ্রহী হয়। সে কারণে শুরুর দিকে এ দায়িত্ব নিতে হয় ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীদের এসোসিয়েশন। তবে এসোসিয়েশনের পক্ষে পুরো পেশাদারিত্ব নিয়ে নিয়মিত আয়োজন করা কঠিন। তাতে এসোসিয়েশনের মুল লক্ষ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই বাজার তৈরি হবার পর – পেশাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়ে, এসোসিয়েশনগুলো সহায়কের ভূমিকায় চলে যায়। এক্ষেত্রে দেখলাম ভিন্ন দৃশ্য। এর আগে এসোসিয়েশনগুলোর কোন আয়োজন না থাকার পরেও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠান শেষে তারা ঘোষণা করেছে যে – এই আয়োজন তারা নিয়মিত করতে চায়। তার মানে – আমাদের বাজার ইতোমধ্যে প্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সিআইও ধারনাটি আমাদের দেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতে কিছুটা নতুন। আমরা ইতিমধ্যে তথ্য প্রযুক্তি প্রধান, সিটিও, হেড অফ আইটি বা আইটি ম্যানেজার নামগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি। তাই তথ্য প্রযুক্তি প্রধানদেরকে এখন পর্যন্ত আমরা কারিগরি লোক হিসেবেই জানি। কিন্তু বর্তমান ব্যবসায়ে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা বহুগুণ বেড়েছে। ব্যবসায়ে ব্যয় খাতগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে তথ্য প্রযুক্তি এগিয়ে চলেছে। ব্যবস্থাপনা, বিক্রয়, বিপণন, বিজ্ঞাপন, বিতরণ সহ অন্যান্য খাতের বাজেটের একটি বড় অংশ চলে গেছে তথ্য প্রযুক্তিতে। সে কারণে প্রযুক্তি প্রধানদের শুধুমাত্র কারিগরি লোক হিসেবে থাকলে চলছে না। তাদের কারিগরি বিষয়ের চেয়ে বেশি ব্যবসা বুঝতে হচ্ছে। ব্যবসাকে কারিগরি সহায়তা দিয়ে মূল্য সহযোজন বা মুনাফা বাড়ানেই তাদের মুল দায়িত্ব। এই সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য নতুন দায়িত্ব ও কর্মকৌশল তৈরি করা হয়েছে।
সিআইও ধারনাটি আমেরিকাতে ১৯৯৬ সালে Clinger-Cohen Act এর মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়। ফেডারেল সিআইও কাউন্সিল এই আইনের মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তি প্রধানের কাজের আওতা বাড়িয়ে দেয়। এক কথায় বলতে গেলে – তাকে কারিগরি ব্যবস্থাপক থেকে, তথ্য প্রযুক্তি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক করে দেয়া হয়। তার সব দায়িত্ব ১০ টি গ্রুপে ভাগ করে “সিআইও হুইল” নামে একটি ড্যাশ-বোর্ড বানানো হয়। ধারনাটির কার্যকারিতার কারণে অচিরেই অন্য দেশের সরকারি বেসরকারি খাত এটা গ্রহণ করে। বিশ্বব্যাপী নিয়মিত চর্চা শুরু হয়। এখন বিভিন্ন দেশে সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় সবগুলো বড় প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রযুক্তির প্রধানের পদ সিআইও।
অনুষ্ঠানে বক্তাদের বক্তব্যে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট ছিল। তথ্য প্রযুক্তি বিষয়টি – ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলাদা কোন বিষয় নয়। এটা কোন ঐচ্ছিক বিলাস দ্রব্য নয়। জীবনের আর দশটি প্রয়োজনের মতই বাস্তবতা। সেক্ষেত্রে যেকোনো প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাত্রায় কাজে লাগানেই সিআিইও দের প্রধান দায়িত্ব। মানুষের জীবন সহজ কারার জন্য প্রথমে মানুষ বুঝতে হবে। তাদের প্রতিদিনের প্রয়োজন এবং কাজকে বুঝতে হবে। সেটাকে সহজ করতে উপযুক্ত প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে। জীবনের আয়োজনে সকল প্রযুক্তি, প্রযুক্তির আয়োজনে জীবন নয়। সেরা প্রযুক্তি নয়, উপযুক্ত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দিন বদলই সিআইওদের মুল কাজ।
আমাদের বর্তমান সরকারের শুরুর দিকে প্রধান তথ্য প্রযুক্তি মহাপরিচালকের পদটি সিআইও করার প্রস্তাব ছিল। পরে শুনেছি তথ্য প্রধানের পদের সাথে সাংঘর্ষিক হবার কারণে সিদ্ধান্ত বদলানো হয়। তবে এই সিদ্ধান্তে অন্য কোন সমস্যার সচেতনতার অভাবটাই মুল কারণ। কারণ আগামী সময়ে প্রযুক্তি ছাড়া তথ্য ব্যবস্থাপনা অসম্ভব। এ দুটি দপ্তরকে যতদিন দুরে রাখা যাবে, ততদিন কোনটারই পূর্ণ ফলভোগ করা যাবে না। দুটি বিষয়কে এক করে একটি ছাতার নিয়ে আসলেই সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যাবে। তাই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা সময়ের দাবী।
বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে বাংলাদেশে এখনই এই ধারনাটি জনপ্রিয় করা দরকার। ভবিষ্যৎ ব্যবসাকে কার্যকরী সহায়তা দেবার জন্য তথ্য প্রযুক্তি প্রধানদের যোগ্য সিআইও হিসেবে তৈরি করা দরকার। তাই সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রযুক্তি প্রধানদের নিয়ে এরকম আয়োজন নিয়মিত করতে হবে। সেমিনার, সামিট এর পাশাপাশি বিশ্বের সেরা কর্মকৌশলগুলো নিয়ে কর্মশালা করতে হবে। ক্রমশ সিআইও হুইলের প্রতিটি বিষয়ে তথ্য প্রযুক্তি প্রধানদের দক্ষ করে তুলতে হবে।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান আই-স্টেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মধুসূদন সাহা এই সামিট সম্পর্কে বলেন- “বাংলাদেশ সি আই ও সামিট ২০১২” হবে এমন একটি প্লাটফর্ম যা দেশের শীর্ষ তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তাগণকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের কাজ করতে সহায়তা করবে ।
আরও পড়ুন: