কুমারখালী উপজেলা

প্রতিটি মানুষের মতোই আমার নিজের উপজেলা হিসেবে কুমারখালী উপজেলা স্পেশাল। কুমারখালী জেলার বাগুলাট ইউনিয়নের বাঁশগ্রামে আমার বাড়ি। রবীন্দ্রনাথ, লালন, কাঙ্গাল হরিনাথ, মীর মোশারফ হোসেন, বাঘা জতিনের সৃতি বিজড়িত কুমারখালি আমার ইন্সপিরেশন।

 

কুমারখালী উপজেলার ইউনিয়ন তালিকা [ মোট ১১ টি ]
কুমারখালী উপজেলার ইউনিয়ন তালিকা [ মোট ১১ টি ]

কুমারখালী উপজেলার ইউনিয়ন তালিকা [ মোট ১১ টি ]

কুমারখালী উপজেলার ইউনিয়ন তালিকা [ মোট ১১ টি ]। ইউনিয়নের বিস্তারিত ও গ্রামের তালিকা দেখতে লিংক এ ভিজিট করুন। কুমারখালী উপজেলা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই উপজেলার শিলাইদহ অঞ্চলে কাটিয়েছেন এবং এখানেই তিনি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন।এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এই উপজেলায় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধক লালন সাঁই-এর সমাধি সৌধ এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন-এর বাস্তুভিটা রয়েছে ।

২৬৫.৮৯ বর্গকিলোমিটার (১০২.৬৬ বর্গমাইল) আয়তনের কুমারখালী উপজেলার পূর্বে খোকসা উপজেলা, পশ্চিমে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা, উত্তরে পাবনা সদর উপজেলা এবং দক্ষিণে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলা অবস্থিত। গড়াই নদীর কোল ঘেসে এর অবস্থান।

কুমারখালী উপজেলার ইউনিয়ন তালিকা :

–  ১ নং কয়া ইউনিয়ন
–   ২ নং শিলাইদহ ইউনিয়ন
–   ৩ নং জগন্নাথপুর ইউনিয়ন
–   ৪ নং সদকী ইউনিয়ন
–   ৫ নং নন্দলালপুর ইউনিয়ন
–   ৬ নং চাপড়া ইউনিয়ন
–   ৭ নং বাগুলাট ইউনিয়ন
–   ৮ নং যদুবয়রা ইউনিয়ন
–   ৯ নং চাঁদপুর ইউনিয়ন
–   ১০ নং পান্টি ইউনিয়ন
–   ১১ নং চরসাদীপুর ইউনিয়ন

 

 

কুমারখালী উপজেলার ইউনিয়ন ম্যাপ
কুমারখালী উপজেলার ইউনিয়ন ম্যাপ

 

কুমারখালী উপজেলার ইতিহাস:

কুমারখালির একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ডাঃ আব্দুস সাত্তার খুশী যেভাবে লিখেছেন:

কুমারখালী নামটি প্রাচীন। রেনেলের ম্যাপে কুমারখালীর নাম পাওয়া যায়। ১৮২০ সালের ৩০ শে জুলাই বিশপ হেবার ঢাকা থেকে ফেরার পথে কুমারখালীতে রাত যাপন করেন বলে তিনি তার ডাইরীতে লিখেছেন। বিশপ হেবার তার ডাইরীতে উল্লেখ করেছেন কুমারখালীতে গোয়ালা, মতস্যজীবী, চাষী ইত্যাদি আদীম প্রকৃতির মত মানুষ দেখতে পেয়েছেন।

কুমারখালীর নামকরণ নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকের ধারণা কমর শাহ নামক একজন লোকের নাম থেকে কুমারখালী হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। দশম শতাব্দীর দিকে গড়াই নদীর নাম ছিল কুমার নদী। খোন্দকার আব্দুল হালিম লিখরত কুমারখালীর ইতিহাসে জানা যায়, নবাব মুর্শিদ কুলিখাঁর কালেক্টর কোমরকুলি খাঁর নাম থেকে কুমারখালীর নাম হয়েছে। যেহেতু নামটি প্রাচীন তাই মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস যেমন পাওয়া যায়না তেমনি কুষ্টিয়া তথা কুমারখালীর ইতিহাসও দুর্লভ।

খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর সমতট রাজ্য ও পঞ্চম শতাব্দীর গুপ্ত শাসন আমলে কুস্টিয়া কুমারখালী অঞ্চল এদের শাসনের আওতায় ছিল কিনা এ নিয়ে মতভেদ ও সংশয় আছে। তবে সপ্তম শতাবদীতে শশাংকের রাজ্যভুক্ত কুষ্টিয়া কুমারখালী অঞ্চল পাল রাজ্যভুক্ত হয় এবং দশম শতাব্দীতে পাল রাজত্বের অবসান পর্যন্ত কুষ্টিয়া, কুমারখালী পাল রাজাদের অধীন ছিল। দশম শতাব্দীর শেষের দিকে বিক্রমপুরের হরিকেলের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। রাজা সামন্তসেনের বাংলার সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন দশম শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে।

প্রায় পৌনে দুইশত বছর সেন রাজত্বর শাসন আমলে কুষ্টিয়া কুমারখালী অঞ্চল তাদের শাসনাধীন ছিল। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন প্রায় ত্রিশ বছর রাজত্ব করেন। লক্ষণ সেনের রাজত্ব কালে ১২০১ সালে মতান্তরে ১২০৩ অথবা ১২০৪ খ্রীষ্টব্দে তুর্কি মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী নদীয়া জয় করেন। এ সময় থেকে বাংলায় মুসলিম শাসনের সুত্রপাত হয়। কুষ্টিয়া কুমারখালী অঞ্চল এ সময় মুসলিম শাসনে আসে। বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় বাংলার মুসলিম শাসনের ক্ষেত্রে একটি গু্রুত্বপূর্ণ ঘটনা।

ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ১৭৬৫ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী দেওয়ানী লাভ পর্যন্ত এই ৫৬২ বছর সুলতানী ও মুঘল শাসন আমলে বাংলার শাসনে ছিলেন সুবাদার, নবাব, নাজিম ও চাকলাদার। এদের প্রায় অনেকেরই শাসনাধীন কুষ্টিয়া কুমারখালী ছিল। মোগল শাসনামলে রাজস্ব আদায় ও আঞ্চলিক প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পরগণা তৈরি করেন। এই পরগণাগুলোকে থানার মর্যাদা দেয়া হতো। ১৮৫৫ সালে ভূমি জরীপ বিভাগ কর্তৃক যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে তেরটি পরগণা নিয়ে ১৪২.৭০ বর্গমাইল আয়তনে কুমারখালী থানা গঠিত হয়। পরগণাগুলোর নাম ছিল ইবরাহিমপুর, মোহাম্মদ শাহী, ভর ফতে ঝংপুর, কান্তনগর, জাহাঙ্গীরাবাদ, বামনকর্ণ নাজির, এনায়েতপুর, বেগমাবাদ, রোকনপুর, তারাউজিয়াল, জিয়া রোখি, ইসলামপুর ও খদকী।

কুমারখালী থানার এই পরগণাগুলো বিভিন্ন সময়ে ভাগ ভাগ হয়ে সামন্ত রাজা, জমিদার কর্তৃক শাসিত হয়েছে। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মত কুমারখালী অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহ হয় বলে ইতিহাসে দেখা যায়। রাজা গণেশ জালাল উদ্দিন মহম্মদ শাহ নাম ধারণ করে কুমারখালী অঞ্চল দখল করেন। এ সময়ে এ অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজাদের সাথে যুদ্ধ হয় রণের মাঠে গড়ের মাঠে যা আজও কুমারখালী রেল স্টেশনের কিছুদূর উত্তর পূর্বে রণের ও গড়ের মাঠ বলে খ্যাত। সেনা নায়ক মাছুম খাঁ ফতেহবাদ পরগণার রাজা মজলিশ কুতুবের সহযোগিতায় কুমারখালীতে স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন।

ঈশাখান তাকে সবরকম সাহায্য সহযোগিতা করে ছিলেন। ঈশাখানের সহযোগিতায় একটি দূর্গ গড়ে তোলেন বর্তমান কুমারখালী শহরের দুর্গাপুরে। মোগল সেনাপতি এহতেশাম নৌবহর নিয়ে মাছুম খার রজ্য আক্রমণ করেন। গড়ের মাঠ ও রণের মাঠে কয়েক দিন যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মাছুম খানের পুত্র মির্জা মুনিম খান নিহত হন। এবং মাছুম খান বিক্রমপুরের দিকে পলায়ন করেন। রাজা সিতারামের রাজধারী ছিল মাগুরার মহম্মদপুরে। কুমারখালীর কয়েকটি পরগণা ছিল তার আওতাধীন। সিতারাম কুমারখালীর খোরশেদপুরে একটি মঠ তৈরি করেছিলেন।

এ সময়ে বাংলার সুবেদার ছিলেন মুর্শিদ কুলি খাঁন। রাজা সিতারাম খুব সাহসী রাজা ছিলেন। রাজা সিতারাম বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেন। মর্শিদ কুলি খান সৈন্য পাঠান। সিতারামের সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ মুর্শিদ কুলি খাঁনের সৈন্যদের সাহায্য করেন নাটোরের রাজা রামজীবন রায়। সৈন্য, অর্থ ও হাতি দায়ে সাহায্য করেছিলেন। রণের ও গড়ের মাঠে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সিতারামের সৈন্যরা পরাজিত হন এবং সিতারাম বন্দী হয়ে নবাব কারাগারে মৃত্যু বরণ করেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁন নাটোরের রাজার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে কুমারখালীর কয়েকটি পরগণা নাটোরের রাজাকে দান করেন।

১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে বৃটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী সুবে বাংলায় সর্বপ্রথম ক্ষমতার অধিকারী হয়। ১৭৬৫ সালে মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের নিটক থেকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকার রাজস্বের বিনিময়ে কোম্পানী বঙ্গদেশের দেওয়ানী শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। কোম্পানী কর্তৃক দেওয়ানী প্রাপ্তির ফলে কুমারখালী কুষ্টিয়া কোম্পানী শাসনাধীনে আসে। ১৭৮৭ সালে এফরেড ফার্ণকে এ জেলায় (ততকালে এ জেলা নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল)প্রথম কালেক্টর এবং জিকেরীকে কালেক্টরের সহযোগী নিযুক্ত করা হয়।

ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাংলায় তাদের শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে জেলা, মহকুমা ও থানা গঠন করেন। এবং প্রশাসনিক সুবিধার জন্য থানা, মহকুমা ও জেলা বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করেছেন। ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা গঠিত হলে কুমারখালী পাবনা জেলাভুক্ত হয়। তার আগে কুমারখালী যশোরের অধীন ছিল। কুমারখালী থানা হবার পরে ভালুকা থানাকে কুমারখালী থানার অধীনে আনা হয়। ১৮৫৭ সালে কুমারখালীকে মহকুমা করা হয়। বালিয়াকান্দি থনা, পাংশা থানা ও খোকসা থানাকে কুমারখালী মহকুমার অধীনে আনা হয়। ১৮১৭ সালে কুমারখালী থেকে মহকুমা উঠে যায় এবং কুমারখালী পুনরায় থানায় রুপান্তরিত হয়ে কুষ্টিয়া মহকুমাভুক্ত হয়ে নদীয়া জেলার অধীনে আসে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর মহকুমার কিছু অংশ নিয়ে বর্তমান জেলা গঠিত হয়। নবগঠিত জেলার নাম রাখা হয় নদীয়া এবং জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হন নাসিম উদ্দিন আহাম্মদ। পরবর্তীতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সৈয়দ মুর্তজা আলী ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে নদীয়া নাম পরিবর্তন করে কুষ্টিয়া জেলা নামকরণ করেন। কুষ্টিয়া সদর মহকুমায় ছয়টি থানা করা হয়। কুষ্টিয়া মহকুমা গঠন হওয়া থেকে কুমারখালী থানা বর্তমান পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেলার অধীন। বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আদেশ ১৯৫৭ বলে থানা কাউন্সিল গঠিত হয়। থানা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসক এবং ভাইস চেয়ারম্যান হন থানা সার্কেল অফিসার উন্নয়ন। যিনি সরাসরি থানা কাউন্সিলের তদারকি করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ১৯৭২ সালে লোকাল কাউন্সিল এ্যাণ্ড মিউনিসিপ্যাল (সংশোধনী) আদেশ অনুযায়ী থানা কাউন্সিলের নাম হয় থানা উন্নয়ন কমিটি। প্রত্যেক থানায় জেলা প্রশাসক কর্তৃক একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অবর্তমানে থানা উন্নয়ন কমিটির সমস্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব সার্কেল অফিসারের(উন্নয়ন) উপর ন্যস্ত থাকে। ১৯৭৬ সালে স্হানীয় সরকার অধ্যাদেশ বলে থানা উন্নয়ন কমিটি থানা পরিষদ নামে পরিচিত হয়। ১৯৮২ সালের ২৩শে ডিসেম্বর স্হানীয় সরকার(থানা পরিষদ এবং থানা প্রশাসন পুনঃ গঠন) অধ্যাদেশ ১৯৮২ ঘোষণা করা হয়। এই অধ্যাদেমের আওতায় প্রথমে উন্নীত থানা পরিষদ গঠন করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত থানা পরিষদকে উপজেলা পরিষদে রুপ দেয়া হয় এবং থানা প্রশাসকের নাম দেয়া হয় উপজেলা প্রশাসন। ১৯৯২ সালে সরকার উপজেলা প্রশাসন বাতিল করে।

সাহেবের আর ডাক্তার সাহেবের বাংলো তৈরি হল আজকের উপজেলা সংলগ্ন বাটিকামারা গ্রামে। আর ইংরেজ সৈন্যরা থাকতে শুরু করলেন বর্তমান দুর্গাপুর স্কুলের কাছে ঐ উচু ভিটার উপর। তারা থাকতো তাঁবুতে, এদিকে দেশে শুরু হয়েছে সিপাহী বিদ্রোহ, ফরায়েজী বিদ্রোহ, তার উপর নীল বিদ্রোহ। আর সবগুলোর ধাক্কা লাগলো কুমারখালীর উপর। ১৮৬১ সালে পার্শন নামক একজন ইংরেজ ক্যাপটেন বেশ কিছু সেনা নিয়ে ফারায়েজী নেতা কাজী মিয়াজানকে গ্রেফতার করার জন্য এসে ‘ঘাঁটি’ গেড়েছিলেন দুর্গাপুর গ্রামে। ছাউনি করেছিলেন আজকের উপজেলা কমপ্লেক্সের কাছে।

শুনা যায় কাজী মিয়াজানকে তাঁর আত্নীয় কল্যানপুরের শেলীর কুঠির কাছে মুন্সীপাড়ার মনৈক মুন্সী ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আর ইংরেজ প্রভু তাঁকে অনেক সম্পদ দিয়েছিল পুরস্কার হিসাবে। আর মুসলমান জনগণের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল। তখন উইলিয়াম সাহেব কোম্পানীর কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখাই তাঁর কাজ। কিন্তু তিনি নিজ স্বার্থই বেশী দেখতেন। তিনি কুমারখালী শহরের আশপাশে নিজ নামে জমিজমা কিনে নীল ব্যবসা শুরু করেন। তার কুঠিরটিই ছিল আজকের মথুরা নাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরাতন স্কুল গৃহটি। তিনি থাকতেন শীতল কোঠা নামক একটি দ্বিতলভবনে।

শীতল কোঠা ছিল কুমারখালী থানার উত্তর দিকে। এখন সেখানে রেল লাইন। কুঠিয়াল হিসাবে উইলিয়াম কেমন ছিলেন জানা যায়না। তবে, তিনি কুমারখালী মহরের ভিত্তি স্হাপক ছিলেন। এই শহরে তিনি দৈনিক বাজার বসালেন। সারা বাজারে নতুন নতুন দোকান হল। দেশী বিদেশী পণ্যে ভরে উঠলো এই বাজার। পাবনার দোগাছি, সেনগ্রাম, মেঘনা জসাই, যশোহরের শৈলকুপা থেকে এই বাজারে নৌকায়, পালকীতে ও ঘোড়ার গাড়ি করে লোক আসা শুরু হলো। উইলিয়াম সাহেব কুমারখালী বাজারের আয় এই এলাকার অন্ধ আঁতুড়ের জন্য ব্যয় করতে লাগলেন।

১৮৩৩ সালে কোম্পানী ব্যবসা গুটিয়ে নিল। কোম্পানীর ব্যবসা করার অধিকার রহিত হয়ে গেল। তখন কুমারখালী বাজারের ভার চলে গেল প্রিন্স দ্বারোকানাথ ঠাকুরের উপর, সন ১৮৬০। দ্বারোকানাথ ঠাকুর লবণ মহল কিনে আর কোম্পানীর বেনিয়ান হিসাবে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইংরেজ অন্তঃ প্রাণী। তিনি তার জমিদারীতে নীলের চাষ করতেন। তার নিজস্ব নীল কুঠিও ছিল বেশ কয়েকটি। কুমারখালী বাজারের দায়িত্বভার পেয়ে তিনি তার অর্থ পাঠাতে লাগলেন ইংল্যাণ্ডে। সেখানকার দরিদ্র লোকের কল্যাণের জন্য।

উইলিয়াম সাহেব ইংল্যাণ্ডে যাবার জন্য তৈরি হলেন জানোবিয়া নামক জাহাজে। বিশাল জাহাজটি তৈরি হল কুমারখালীর গড়াই নদীর ঘাটে। সমস্ত মালপত্র তুললেন উইলিয়াম সাহেব জানোবিয়া জাহাজে। সেই জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইংল্যাণ্ড যাবেন সব ঠিক ঠাক কিন্তু কোম্পানীর হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ এল তাকে ধর। তিনি কোম্পানীর বহু অর্থ আত্নসাত করেছেন। তাঁকে জানোবিয়া জাহাজেই গ্রেফতার করা হল। জাহাজসুদ্ধ তাকে ঢাকায় নেওয়া হল। তিনি সব বেচে দিয়ে কোম্পানীর দায় শোধ করলেন। ফলে আর তাকে হোমে (ইংল্যাণ্ডে)হল না। ঢাকা শহরেই তিনি দারুন দুঃখ কষ্টে প্রাণ ত্যাগ করলেন।

কুমারখালী সাব ডিভিশন পাবনা জেলায় ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। সারা দেশ জুরে আগুন জ্বলছে। কুমারখালীর ইংরেজ অধিবাসীগণ ভীত সন্ত্রস্ত। তারা পাবনায় মিটিং করলেন। বিদ্রোহীরা যাতে নদী পথে ঢাকায় যেতে না পারে সেই কারণে কুমারখালীর নদীপথে পাহারা বসানো হল। ইংরেজ নৌসেনা আসলেন কুমারখালী শহরে। কুমারখালীতে ইংরেজ নৌঘাঁটিটি সেইবারই প্রথম হল। নৌসেনারা মদমত্ত হয়ে একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে ছিল। তারা প্রচার করে দিল বিদ্রোহী সিপাহীরা গোলাগুলী করে জাহাজে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েঠে। জাহাজটির নাম ইন্দ্র। রসদবাহী জাহাজ।

তদন্তে আসলেন পাবনার কর্তব্যরত ম্যাজিষ্ট্রেট সি এফ হ্যারভে। আর তার সাথে আসলেন বাঙ্গালী ম্যাজিষ্ট্রেট গুরুদাস চক্রবর্তী। প্রমান হল বিদ্রোহীরা নয় নৌসেনারাই আগুন লাগিয়েছে জাহাজে। সময় ১৮৫৮ সাল। পাবনার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট জে এ ওয়ার্ড কুমারখালী শহরে আসলেন এক কদন্ত কার্যে। এলাহাবাদ থেকে কলকাতা যাবার পথে ‘চার্লস এলেন’ নামক একটি জাহাজ থেকে কোম্পানীর স্ট্যাম্প হয়েছে। উনিশ রীম কোম্পানীর স্ট্যাম্প কাগজ উদ্ধার হয় কুমারখালী শহর থেকে। পাওয়া গেল রামগতি চৌধুরী, মধুরা বণিক, দ্বারিকা বণিক ও মাধব বণিকের কাছে। কিন্তু সেই যাত্রায় কারও শাস্তি হয় নাই।

জাহাজের নাবিকরাই চুরি করে বেচে দিয়েছিল সেই সব স্ট্যাম্প এবং ব্যবসায়ীরা সরল বিশ্বাসে কিনেছিল। কোম্পানী তো আর নিজ নাবিকের বিরুদ্ধে মামলা করবে না। তাই পাবনার ম্যাজিষ্ট্রেট এইচ এল ডামপিয়ার সব আসামীদের খালাস করে দিলেন। একদিকে সাহেবদের আগমণ আর একদিক দিয়ে ঢাকা আর কলকাতার মধ্যবর্তী স্হান, তা ছাড়া জাহাজ ঘাট সুতরাং চতুর্দিক হতে শিক্ষিত ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কুমারখালী শহরে এসে ভিড় করতে লাগলো। ফলে গড়ে উঠলো একটি মিশ্র CULTURAL CENTER।

নব্য শিক্ষত ধনিকের সন্তানরা গড়ে তুললেন মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কুমারখালীর ব্রাক্ষ সমাজ ১৮৪০ সালে। ব্রক্ষগুরু কেশব চন্দ্র সেন-এর উতসাহে রামতন লাহিড়ী উদ্বোধন করলেন সেই ব্রাক্ষ মন্দির। রায় বাহাদুর জলধর সেনের বড় ভাএ অধ্যক্ষ হেরম্ব মৈত্র, কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার, বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবচন্দ্র বিদ্যার্নব প্রমুখ ব্যক্তিগণ এই উতসাহ ও উদ্দীপনার মাঝে ব্রাক্ষ ধর্মাবলম্বী হয়ে পড়লেন সেই সময়। জমিদাররা নিযুক্ত করলেন চৌকিদার আর দফাদারদের। দফাদার আর চৌকিদারদের বেতন দিতে হত জমিদারদের খাজাঞ্চি খানা থেকে।

পরে জমিদাররা সেই দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পেতে সরকারী কোষাগার থেকে দফাদার আর চৌকিদার-এর বেতন দেবার দাবী জানালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তা মেনে নেয়। চৌভব মলের সময় বাংলা ১৯টি সরকারে বিভক্ত ছিল। ১১টি সরকার গঙ্গার উত্তর পূর্বে আর ৮টি সরকার গঙ্গার পশ্চিমে ভাগীরথী তীরে আর তার সঙ্গম স্হলে। ফলে কুমারখালী চলে যায় বরেন্দ্র অঞ্চলের সাথে তাই ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা ঘোষণা হলে যুক্ত হয় পাবনার সাথে। কিন্তু গড়াইয়ের উত্তর পূর্বকূল যুক্ত ছিল যশোহরের সাথে।

প্রথম জেলা ঘোষিত হল ১৭৮৭ সালে নদীয়া, তারপর রাজশাহী, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি। ১৮৫৭-(১৮৬০) সালে কুমারখালী মহকুমা শহরে পরিণত হয়। থানা কুমারখালী, ভালুকা, পাংশা, বালিয়াকান্দি। অধুনাকালের খোকসা তখন কুমারখালী থানায় অন্তর্গত ছিল। কুমারখালী শহরে একজন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও মুন্সেফ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রথম মুন্সেফ হয়ে আসেন ইশান চন্দ্র দত্ত, ১৮৬১ সালের ৮ই মে তারিখে নীকা ডুবিতে তিনি মারা যান। তার পুত্র সিভিলিয়ান রমেশ চন্দ্র দত্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক ছিলেন। পরবর্তীতে মাইকেল মধুসুদন দত্তের চাচা উমেশ চন্দ্র দত্ত মুন্সেফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বলে জানা যায়।

সেই সময় কুমারখালী মহকুমার সাব জেলা ছিল আজকের এলংগী গ্রামে । যেখনে এলংগী আচার্য প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিক সেই স্থানেই। জেল খানার পুরানো ইন্দারাটি এখনও টিকে আছে। কুমারখালীর শিক্ষা ব্যবস্থাও ভাল ছিল। নবাবী আমল থেকেই এখানে দোল চতুষ্পাঠী মক্তব পাঠশালা ছিল। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে চন্দ্র কুমার তর্কবাগিশ, সীতানাথ স্মৃতি ভূষণ প্রমুখ পণ্ডিতদের দোলের বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ হয়েছিল। কুমারখালী (তুলসী গ্রাম) কে তখন বলা হত দ্বিতীয় নবদ্বীপ। ১৮৪৪ সালে লর্ড হাডিঞ্জ ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল নিযুক্ত হলেন।

ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বোর্ড অব ডাইরেক্টর সিদ্ধান্ত নিল কাজকর্মে কিছু কর্মচারী প্রয়োজন, সেই উদ্দেশ্যে কোম্পানী ১০০টি বাংলা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। কুমারখালী শহরে বাংলা বিদ্যালয় স্থাপিত হইল। কাঙ্গাল হরিনাথ বাংলা বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন। ১৮৪৮ সালে লর্ড ডালহৌসী গভর্ণর জেনারেল। শুরু হল স্কুলগুলো ও নব প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোতে সরকারী অনুদান দেবার প্রক্রিয়া GRANT IN AID চালু হল । প্রথম নদীয়া কলেজ ও ২টা স্কুল GRANT IN AID পেল। কুমারখালীও পিছু পড়ে রইল না। প্রক্রিয়া শুরু হল।

নীল কুঠির ম্যানেজার ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রী মথুরা নাথ কুণ্ডু মহাশয় কুমারখালী শহরের এলংগী মৌজার নীল কুঠিটি কিনে নিলেন এবং শুরু করলেন ইংরেজী স্কুল। ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হল কুমারখালী এম, এন, ইংলিশ হাই স্কুল। সিভিলিয়ান নমেশচন্দ্র দত্ত, ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, মোহিনী মিলের প্রতিষ্ঠাতা মোহিনী মোহন চক্রবর্তী এরা হলেন সেই স্কুলের প্রথমদিকের ছাত্র। আবার কুমারখালী শহরে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হল ১৮৬৩ সালে কাঙ্গাল হরিনাথের চেষ্টায়। তিনি তার নিজ বাড়িতেই প্রথমে স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয় পরে স্থানান্তরিত হয়।

আর একদিকে কুমারখালীর কাজী পাড়ার মক্তবে পড়ান হত আরবী, ফারসী আর হেকিমী শাস্ত্র। প্রয়োজন দেখাদিল নারী শিক্ষার । সেই বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হল ১৮৫৭ সালে। কুমারখালী বালিকা বিদ্যালয় কুমারখালী শহরে ইতোমধ্যেই চায়ু হয়ে গেল। একটি ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয়, দুইটি পাঠশালা, ও চার পাঁচটি টোল আর একটি মাদ্রাসা, আর কাজী, মুন্সী, খন্দকারদের বাসগৃহে ইসলামিক শিক্ষার অনেকগুলো মক্তব। সেই ১৮৫৬ সালেই লেঃ গভর্ণর ফেডারিক হ্যালিডে তার প্রথম নিযুক্তির পর স্ট্রীমার যোগে নদীয়ার সমস্ত শহরগুলো পরিদর্শন শুরু করেন।

কুমারখালী শহর পরিদর্শন করে এর বিন্যাস অবকাঠামো পয়ঃ প্রণালী দেখে তিনি মুগ্ধ হন। নবাবী আমলে আইন শৃংখলা দেখার দায়িত্ব ছিল ফৌজদারের উপর। কাজীরা ফৌজদারী মামলার বিচার করতেন। ইংরেজ রাজত্ব চালু হবার পরও দীর্ঘদিন সেই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। নবাবী আমলে থানার নাম ছিল থানাই। দারোগার নাম ছিল থানাদার। নদীবন্দর পাহারায় ছিল নৌ চৌকী। কুমারখালী শহরের উত্তরে একতারপুরে ছিল নৌ চৌকি। পূর্বে ফুলবাড়ী (বর্তমান খোকসা থানার অন্তর্গত) আর এক নৌ চৌকি ছিল। সেই ফুলবাড়ী নৌ চৌকি চালু হয়েছিল দিল্লীশ্বর শাজাহানের রাজত্বের সময়।

তখন পদ্মা নদী (বর্তমান শিলাইদহের কাছে কুঠি বাড়ির কাছে) আড়পাড়া কশবা গ্রামের পাশদিয়ে ফুলবাড়ী গ্রামের কিনার ঘেঁষে প্রবাহিত হত। সেই স্মৃতি আজও বহন করে কশবা-কণ্ঠ গজরার ভামোশ। সেই সময় সারা দেশ বিভক্ত ছিল অনেকগুলো চাকলায়, চাকলাগুলোর আয়তন ছিল আজকের থানার আয়তনের সমান। নবাবী আমলে থানাদারদের কাজ ছিল জমিদারদের উপর লক্ষ্য রাখা আর নবাবী সেরেস্তায় সংবাদ পাঠানো। ১৮০২ সালে বাংলাদেশের বড় লাট ডালহৌসী আধুনিক থানা প্রতিষ্ঠিত করলেন। কুমারখালী, ভালুকা, দুই জায়গায় ২টি থানা প্রতিষ্ঠিত হল। থানার কর্মকর্তার নাম হল ওভারশিয়ার। জমিদারদের উপর দায়িত্ব হল নিজ নিজ এলাকার চুরি, ডাকাতি, খুন, হাঙ্গামার সংবাদ দিতে হবে থানায়।

১৮৫৪ সালে কুমারখালী অঞ্চলে আশ্বিনে ঝড় হয়। গড়াই নদীতে জাহাজগুলোর ডুবে যায়। লোকজন নৌকায় ডাঙ্গায় উঠে। খবর হয়েছিল, “কই মাছ তালগাছে”।

১৮৫৮ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাত থেকে ইতলেশ্বরী ভিক্টোরিয়ার হাতে ভারত শাসন এর দায়িত্ব অর্পিত হয়।

১৮৫৯ সালে কুমারখালী এলাকায় ঘটে এক মহাপ্লাবন। মাঠ-ঘাট-নদনদী-বিল হাওর সব একাকার হয়ে যায়।

১৮৬২, এই সময় সারা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। বহু লোক মারা যায়। তখন চালের মণ ২.৫০টাকা।

১৮৫৯ সালে স্যার পিটার গ্যাট ছোট লাট নিযুক্ত হয়ে তিনি কুমারখালী নদী দিয়ে কলকাতা থেকে পাবনা যাবার জন্য জাহাজ যোগে কুমারখালীর জাহাজ ঘাটে আসেন। এর আগে কুমারখালী এসেছিলেন ঢাকা থেকে কলকাতা ফেরার পথে। বিশপ হেপর এসেছিলেন কুমারখালী শহরে। এই শহরে খৃস্টানদের অবস্থান তিনি স্বচক্ষে দেখে গিয়েছিলেন। দেখেছিলেন গোয়ালাদের বহু বাথান। পিটার গ্যাট একসময় স্টীমারে পাবনা যাচ্ছিলেন। তখন দুই কূলে নীল চাষীরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছিল। সেই সময় দারুণ সাহসিক এক কাজ করেছিলেন কুমারখালী এস এন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মথুরা নাথ কুণ্ডু। তিনি নৌকা দ্বারা স্টীমার থামাবার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন গড়াই নদীর উতস মুখে।

ছোট লাট ষ্টীমার থামিয়ে তার আর্জি শুনেছিলেন এবং সিক্তবস্ত্রে বিনয়ের সংগে আবেদন করেছিলেন কুমারখালী এম এন ইংরাজী হাই স্কুলের সরকারী সাহায্যের জন্য। আবেদন পরে মঞ্জুর হয়েছিল। স্যার পিটার গ্যাট দরবার বসিয়ে ছিলেন পাবনা জেলা সদরে। কুমারখালীর শত শত নীল চাষী হাজির হয়েছিল সেদিন। স্যার পিটার গ্যাট ১৪ দিনের সফর শেষে ফিরে গিয়েছিলেন কলকাতায়। তার আদেশে ১৮৬০ সালে নদীয়া জেলা গঠিত হল কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কৃষ্ণনগর, মাগুড়া, কোটচাঁদপুর, নড়াইল, যশোহর, বনগাঁ, শান্তিপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বসিরহাট, বারাসাত, আলিপুর, পোর্ট মাঙ্গালা, ডাইমণ্ড হারবার নামক সাব ডিভিশান নিয়ে।

খুলনা, করিমপুর, শান্তিপুর ইত্যাদি বিষয়গুলোর জনসাস্থ্য, শিক্ষা, পয়ঃপ্রণালী, পয়ঃনিষ্কাশন, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়গুলো স্থানীয়ভাবে পরিচালনার জন্য মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সময় ১৮৬৯ সালের ১লা এপ্রিল লেঃ গভর্ণর নদীয়া (নবদ্বীপ), কুষ্টিয়া, কুমারখালী, মেহেরপুরে পৌরসভা গঠনের জন্য হুকুম জারি করলেন। কুমারখালী পৌরসভা গঠিত হল। প্রশাসক হলেন সরকার নিযুক্ত মহকুমা হাকিম। তিনি কমিশনারদের দ্বারা পৌরসভা পরিচালনা শুরু করলেন। এই হল কুমারখালী পৌরসভার গোড়ার কথা।

সেই যুগের পৌরবাসীদের কিছু কথা দিয়েই শেষ করবো কুমারখালী পৌরবাসভার সেকাল। কুমারখালী পৌর বাজারটির পাশেই ছিল সরকারী দপ্তরগুলো। এখন যেখানে হীরা টেক্সটাইলসহ বেশ কিছু তাঁতের ফ্যাক্টরী হয়েছে। সাব রেজিষ্ট্রি অফিস ছিল রেল ষ্টেশনের কাছেই। কুমারখালী থানা তার আদি জায়গায়ই রয়েগেছে। পুরাতন পোষ্ট অফিস বিল্ডিং আজও অক্ষত রয়েছে। নীলকুঠির দালানটি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। বাজারের পুরাতন দালানগুলোর কিছু কিছু আজও টিকে আছে।

কুমারখালী শহরের আদিবাসী পাল-অর্থাত কুমাররা। এদের প্রচীন নিবাস গৌড়ে। বর্গির হামলা ১৭৪০-১৭৫০ শুরু হলে এরা চলে আসেন কুমারখালী অঞ্চলে। তাদের সাথে আসে তন্তুবায় সম্প্রদায়ের লোকজন, যারা প্রামাণিক, বসাক ও পোদ্দার নামে খ্যাত। বসাকরা সাধারণত রঞ্জক। সুতরাং রং করা দ্রব্যের ব্যবসা করতেন। এদের আদি নিবাস রাজ মহল (বর্তমান বিহার) সেখান থেকে এদের কিছু অংশ ইংরেজ আসার আগেই কলকাতার সূতাপট্রির হাটে ব্যবসা করতেন আর কিছু কুমারখালী, পাবনা এলাকায়। কুমারখালীর কুমার (পালদের) কিছু লোক কলকাতায় কুমারটুলিতে বসবাস শুরু করেন।

ব্যবসা উপলক্ষে ও কুঠিয়ালদের কুঠিতে চাকরির উদ্দেশ্যে আসেন বেনে দত্তর। এ ছাড়া অধিকাংশ কুলিন হিন্দু জমিদারদের নায়েব, আমলা, গোমস্তা হিসাবে কর্মরত থাকাকালীন জমিজমার মালিক হন। ফলে এখানে চক্রবর্তী, বাগচি, লাহিড়ী, গোস্বামী, অধিকারী, সান্যাল, ভাদুরী, মুখার্জি, ব্যানার্জি, মজুমদার, খৈত্র, রায় বংশীয় ব্রাক্ষণ কুলের আধিক্য দেখা যায়। পূজারী ব্রাক্ষণদের মধ্যে ভট্রাচার্য্য গোত্রের আদিপুরুষ নিম চন্দ্র ভট্রাচার্যই এ এলাকার আদি ব্রাক্ষণ এবং তারই নির্মিত প্রাচীন অট্রালিকাটি অদ্যাবধি কুমারখালী শহরে বিদ্যামান আছে।

এ ছাড়া ত্রিবেদী ও চতুর্বেদী বংশীয় ব্রাক্ষণরা এখানে বসবাসরত ছিলেন। অতীতে দু-একঘর রাধুনী বামুনের আস্তিত্ব লক্ষ করা যায় । অধিক সংখ্যাক ঘোষ, বোস, সেন, মিত্রসহ নন্দী ও চাকী বংশীয় কায়স্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা অধিকহারে এখানে ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। এই থানায় রোকনপুর, ব্রক্ষণকর্ণ, মোহাম্মদশাহী, জাহাঙ্গীরাবাদ, ইবরাহিমপুর, ইসলামপুর, নাজির এনায়েতপুর, ভড় ফতেহপুর, জিয়া রাথী, বেগমাবাদ, কান্তনগর প্রভৃতি পরগনায় জমিজমা অন্তর্ভূক্ত থাকায় বিভিন্ন জমিদারগণের কাচারী ছিল।

ফলে পাইক বরকন্দাজ হিসাবে রায় সিং নামক ক্ষত্রিয় বামুনদের বসবাস ছিল। চৈতন্য দেবের আগমনের কারণে এই এলাকায় বৈরাগী সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাসের প্রধান্য লক্ষ্য করা যায়। বেশ কয়েকটি গোপী নাথ মন্দিরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কুবের, মণ্ডল, বিশ্বাস, চণ্ডাল, যোগী, নাথ এরাও ছিল এই শহরে। কুমারখালী শহরের আশপাশে সম্ভ্রান্ত মুসলমান হিসাবে সৈয়দ, খন্দকার, কাজী, মোল্লা, মুন্সীরা, বসবাস করতেন। শেখ, সর্দার, খাঁ এরা শহরের আশে পাশেই বসবাস করতেন। ঘোড়ার গাড়ি চালনার জন্য শাহ (খুকসু) সম্প্রদায়ের লোকেরা শহরের মধ্যেই বসবাসরত ছিলেন।

এককালে সেরকান্দী ও দুর্গাপুর অঞ্চল মিলে তাদের জন্য মাহাজীপাড়া নামক একটি পাড়াও ছিল। মুসলমান তাঁতীরা পূর্ব থেকেই বাটিকামারা অঞ্চলে বসবাস করতেন। এ ছাড়া ধর্মান্তরিত বিশ্বাস ও মণ্ডল নামক মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রথমে এদ্রাকপুর গ্রামে পরবর্তীতে তেবাড়িয়া ও এলংগী এলাকায় বসবাস শুরু করেন। এই সব সম্প্রদায়ের সৌহার্দ ও ভাতৃত্বের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠলো কুমারখালী শহর ও কুমারখালী পৌরসভা সেই ১৮৬৯ সালে।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment